মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হস্তক্ষেপে যুদ্ধবিরতি কার্যকরের ৪৮ ঘণ্টা পর গত সোমবার সন্ধ্যায় জনসম্মুখে হাজির হলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। অপারেশন সিঁদুরের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পাল্টা আঘাতে সিঁদুরের রঙ যে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে,তার স্পষ্ট ছাপ ছিল মোদির চোখে-মুখে।
মোদির দাবি, ভারতের হামলা থেকে বাঁচতে পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি চেয়েছে। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মোদির দেওয়া ভাষণের ঠিক এক ঘণ্টা আগে হোয়াইট হাউসে এক সংবাদ সম্মেলনে সাফ জানান-তার ধমকেই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, যুদ্ধবিরতি-পরবর্তী কার্যক্রম নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প স্পষ্ট বলেছেন, এখনই যুদ্ধ বন্ধ করো। নইলে আমেরিকার সঙ্গে ব্যবসা করতে পারবে না। আগামী দিনে ব্যবসা করতে চাইলে অবশ্যই যুদ্ধবিরতি পালন করতে হবে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প মোদি সরকারকে রীতিমতো অবাক করে কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে মার্কিন মধ্যস্থতার কথাও জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী মোদি একেবারেই চুপ। ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মোদির বক্তব্য নিয়ে চলছে ব্যাপক সমালোচনা। সেই সমালোচনার কোনো জবাব আসেনি মোদি সরকারের পক্ষ থেকে।
উল্লেখ্য, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে তার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, মার্কিন কূটনৈতিক মধ্যস্থতায় দক্ষিণ এশিয়া একটি পারমাণবিক যুদ্ধ থেকে বেঁচে গেছে। তিনি বলেন, আমরা পারমাণবিক যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছি। আমি মনে করি, এই যুদ্ধ একটি পারমাণবিক যুদ্ধে রূপ নিতে পারত,যার ফলে মারা যেত লাখ লাখ মানুষ।
ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, যুদ্ধ থামানোর বিনিময়ে আমরা বাণিজ্য বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছি। আমেরিকা উভয় দেশের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে প্রস্তুত। আগামী দিনগুলোতে আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াতে যাচ্ছি। ভারতের সঙ্গেও আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে। ইতোমধ্যে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনা শুরু হয়েছে। খুব শিগগিরই পাকিস্তানের সঙ্গেও শুরু হবে।
গত শনিবার তার প্রশাসনের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি হয়েছে মন্তব্য করেন ট্রাম্প। বাণিজ্যকে যুদ্ধ বন্ধের হাতিয়ার উল্লেখ করে ট্রাম্প আরো বলেন, মানুষ অতীতে কখনোই যুদ্ধ বন্ধে এভাবে বাণিজ্যকে ব্যবহার করতে পারেনি, যা আমি করে দেখিয়েছি। আমি উভয় দেশকে সাফ বলেছিÑ আমেরিকার সঙ্গে ব্যবসা চাইলে যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। যুদ্ধ বন্ধ না হলে আমেরিকা কোনো ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য করবে না। আমার এই বক্তব্যের পর উভয় দেশ তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়।
ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক রাবিশ কুমার তার ইউটিউব চ্যানেলে মোদির ভাষণ এবং ট্রাম্পের বক্তব্য পাশাপাশি রেখে একটি বিশ্লেষণ করেছেন। সে বিশ্লেষণেই ফুটে উঠেছে মোদির বক্তব্যের অসারতা। মোদির বক্তব্যের নানা দিক নিয়ে রাবিশ রীতিমতো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। রাবিশের বিশ্লেষণে প্রমাণিত হয়েছে মোদির বক্তব্য মূল সত্যকে এড়িয়ে বাগাড়ম্বর ছাড়া আর কিছুই নয়।
ট্রাম্পের বক্তব্যের সূত্র ধরে গণমাধ্যমব্যক্তিত্ব রাবিশ কুমার বলেন, ‘ট্রাম্প বলেছেন তার ধমকেই যুদ্ধ বন্ধ হয়েছে। যুদ্ধ বন্ধের জন্য আমিই হুমকি দিয়েছি। আমিই যুদ্ধ বন্ধের কথা বলেছি এবং তারা দুই পক্ষ আমার কথা মেনে নিয়ে যুদ্ধ বন্ধ করেছে।’
এদিকে ট্রাম্পের এমন বক্তব্যের পর নরেন্দ্র মোদি তার ভাষণে বলেন, ‘আমরা পাকিস্তানকে শায়েস্তা করেছি। আমাদের সেনারা পাকিস্তানকে দেখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে একই ঘটনা নিয়ে পৃথিবীর দুই প্রান্তে দুজনের কাছ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা দুটি বয়ান আসছে।
রাবিশ কুমার ভারতীয় গণমাধ্যমের সমালোচনা করে বলেন, মোদির ভাষণ শেষ হতে না হতেই মোদির সমর্থক মিডিয়াগুলো (যা গদি মিডিয়া নামে পরিচিত) রীতিমত মোদির বক্তব্য প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মোদির পুরো ভাষণটি ছিল সত্যকে আড়াল করে বাগাড়ম্বরে পরিপূর্ণ। মজার বিষয় হচ্ছে, পুরো দুনিয়া দেখেছে যুদ্ধবিরতি কীভাবে হয়েছে। আমেরিকার ভূমিকা তো সবাই দেখেছে। কিন্তু মোদি তার ভাষণে যুক্তরাষ্ট্র অথবা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নামটি পর্যন্ত একবারও মুখে আনেননি। মোদি তার পুরো ভাষণে শুধুই গলা ফাটালেন। বাস্তবে তার চোখে-মুখে ছিল হতাশার ছাপ। মোদি দাবি করলেন, আমরা পাকিস্তানকে তছনছ করে দিয়েছি। ভারতীয় ড্রোন আর মিসাইল হামলায় পাকিস্তানের সামরিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু পাকিস্তানের পক্ষ থেকে রাফালেসহ ভারতের ৫ যুদ্ধবিমান ধ্বংস, ৫০ জনের ওপর ভারতীয় সেনা হত্যা, ভারতের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমকে অকেজো করে দেওয়াসহ ভারতের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির দাবি করা হয়েছে। সে ব্যাপারে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করলেন, ‘ভারত পরমাণু হামলা নিয়ে কোনো ধরনের ব্ল্যাক মেইলিং সহ্য করবে না। পাকিস্তান ভারতীয় হামলার মুখে নিজে বাঁচতে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছে।’ তবে মোদির এই দাবির পক্ষে একটি শব্দও মার্কিন প্রেসিডেন্ট উচ্চারণ করেননি বলে মন্তব্য করেন রাবিশ কুমার।
মোদি তার ভাষণে ঘোষণা দিলেন, পাকিস্তান সন্ত্রাস বন্ধ না করা পর্যন্ত দেশটির সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা করবে না ভারত। কিন্তু ট্রাম্প তো আগেই জানিয়ে দিয়েছেন নিরপেক্ষ ভেন্যুতে দুই দেশ আলাপ-আলোচনা করবে। কাশ্মীর সমস্যার সমাধানের জন্য নিজেই উদ্যোগ নেবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্পের এই বক্তব্যের মাধ্যমে কাশ্মীর এখন আন্তর্জাতিক ইস্যু। অথচ মোদি এ ব্যাপারে কোনো কথা বলেননি।
উল্লেখ্য, বিগত বছরগুলোতে ভারত প্রায় প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিল যে, কাশ্মীর ইস্যুতে তৃতীয় পক্ষের কোনো মধ্যস্থতা মানবে না দিল্লি। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতার প্রস্তাবের পর প্রচণ্ড প্যাঁচে পড়েছে মোদি সরকার। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তার উদ্যোগের জন্য ধন্যবাদ জানানো হয়েছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে তার ভূমিকা দক্ষিণ এশিয়া ও এর বাইরে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে বলে আমরা আশা করি।