সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৫৮ অপরাহ্ন

খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ কোটি টাকা

  • সময়: শনিবার, ৯ নভেম্বর, ২০২৪, ৯.৫০ এএম
  • ২৬ জন

আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে দেশের ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোয় খেলাপি ঋণ বেপরোয়া গতিতে বেড়েছে। আর্থিক খাতে সুশাসন না থাকায় ব্যাপকভাবে বড় বড় জাল-জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। এর মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণের প্রায় সবই খেলাপি হয়ে গেছে। যে কারণে মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়েছে খেলাপি ঋণ। ২০০৯ সালের শুরু থেকে গত জুন পর্যন্ত ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানিতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ১২ হাজার ৫২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক খাতে বেড়েছে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা। ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোয় বেড়েছে ২৪ হাজার ১ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত একাধিক প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে খেলাপি ঋণের এমন চিত্র পাওয়া গেছে। ব্যাংকাররা মনে করেন, খেলাপি বৃদ্ধির প্রকৃত অবস্থা এই চিত্রের চেয়েও বেশি ভয়াবহ। কারণ খেলাপির প্রকৃত চিত্র এতে ফুটে ওঠেনি। অনেকে ঋণখেলাপি হওয়ার যোগ্য হলেও তা খেলাপি করা হয়নি। নিয়মের বেড়াজালে প্রলেপ দিয়ে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। এখন সেগুলো প্রকাশ পাচ্ছে। সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে ২০০৯ সালের শুরুতে। তারা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত টানা ক্ষমতায় ছিল। ওই সময়ে আর্থিক খাতের খেলাপি ঋণে আওয়ামী লীগ সরকারের দায় রয়েছে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে এবং ২০০৯ সালের শুরুতে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। গত জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ সাড়ে ৮ গুণ বেড়েছে।

ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোয় ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে বা ২০০৯ সালের শুরুতে খেলাপি ঋণ ছিল ৭১০ কোটি টাকা। জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৭১১ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ১ কোটি টাকা বা প্রায় ৩৫ গুণ।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে ২৪টি বড় ধরনের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এর বড় অংশই খেলাপি হয়ে পড়েছে।

সরকার পতনের পর জালিয়াতির তথ্য বেশি করে প্রকাশিত হচ্ছে। এতে আগামী দিনে খেলাপি ঋণ আরও বেপরোয়া গতিতে বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের শাসনামলের পুরো সময়টিতেই ঋণখেলাপিরা ছিল অপ্রতিরোধ্য। তাদের পক্ষে কাজ করেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। ফলে খেলাপিরা ঋণ শোধ না করেই একের পর এক ছাড়ের সুবিধা নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও খেলাপিদের একের পর এক ছাড় দিয়ে পুরস্কৃত করেছে। কিন্তু ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক হলেও সংস্থাটি ব্যাংক খাতকে ছেড়ে দিয়েছিল লুটপাটকারীদের হাতে। যে কারণে ব্যাংকগুলো এখন তীব্র তারল্য সংকটে ভুগছে। কিছু ব্যাংক গ্রাহকদের টাকা দিতে পারছে না।

সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাতের লুটপাটের চিত্র আরও প্রকাশ হতে থাকে। আগে জানা গিয়েছিল ইসলামী ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপ ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এখন জানা যাচ্ছে ৭৫ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে। এসব ঋণের মধ্যে ২৮ হাজার কোটি টাকা খেলাপির পথে রয়েছে। অন্যান্য ব্যাংকেও খেলাপি ঋণ বাড়বে। ন্যাশনাল ব্যাংক সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা খেলাপি করেছে। সোশ্যাল ইসলামী, ইউনিয়ন, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকসহ অনেক ব্যাংকেই খেলাপি ঋণ বেড়ে যাবে। তখন প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণও বাড়বে।

অর্ধনীতিবিদরা মনে করেন, রাইটঅফ, খেলাপির যোগ্য ঋণকে খেলাপি না করা, আদালতের নির্দেশে ঋণ খেলাপি না করাসহ নানা কারণে অনেক ঋণ নিয়মিত রয়েছে। এসব মিলে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ এখন ৫ লাখ কোটি টাকার বেশি হবে।

২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি স্থিতিশীল ছিল। ২০১২ সালে খেলাপি ঋণ দ্বিগুণ বেড়ে ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ২০১১ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা। ওই এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়ে যায় ২০ হাজার ১০৮ কোটি টাকা। ওই বছরেই হালমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় ঋণ খেলাপি হতে থাকে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম হঠাৎ করে কমে যাওয়ার কারণেও অনেকে খেলাপি হয়ে পড়েন। ফার্মার্স ব্যাংকেও জালিয়াতির কারণে খেলাপি ঋণ বেড়ে যায়। এর প্রভাবে মোট খেলাপি ঋণ বেড়ে যায়।

২০১৩ সালে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমে ৪০ হাজার কোটি টাকার ঘরে নেমে এলেও ২০১৪ সালে আবার বেড়ে এই প্রথমবার অর্ধলক্ষ কোটি টাকা অতিক্রম করে। ওই বছরে খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ৫০ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। ওই সময়ে বেসিক ব্যাংকে জালিয়াতির কারণে খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকে। এরপর থেকে খেলাপি ঋণ বাড়তেই থাকে। কারণ, ওই সময় থেকে সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকে জালিয়াতির ঋণ খেলাপি হতে থাকে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সার্বিক খেলাপি ঋণের স্থিতিতে। ২০১৫ সালে সামান্য বাড়ে। ২০১৬ সালে বেড়ে ৬২ হাজার ১৭০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। জালিয়াতির প্রভাবে পরের তিন বছর খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ২০১৯ সালে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, ব্যাংকে আর খেলাপি ঋণ বাড়বে না, কমবে। তিনি হিসাবের মারপ্যাঁচের মাধ্যমে খেলাপি কমাতে পারেননি। ২০২০ সালে সামান্য কমে ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকায় নামে। এর আগে ২০১৯ সালে খেলাপি ছিল ৯৪ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে প্রথম খেলাপি ঋণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। ওই বছরে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। এরপর আর লাখের নিচে নামেনি খেলাপি ঋণ। ২০২৩ সালে তা বেড়ে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। গত জুনে তা আরও বেড়ে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকায় দাঁড়ায়।

নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোয়ও খেলাপি ঋণ বেড়েছে বেশি হারে। ২০০৮ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ৭১০ কোটি টাকা, যা ওই সময়ে মোট ঋণের ৬.৭ শতাংশ। ২০১০ সালে তা বেড়ে ১ হাজার ৫০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ২০১২ সালে খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে ১ হাজার ৪৬০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। আওয়ামী লীগ সরকারের শুরুতেই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় জালিয়াতির ঘটনা ঘটতে থাকে। যে কারণে সার্বিকভাবে খেলাপির পরিমাণ বেড়ে যায়। ২০১৪ সালে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৯৭০ কোটি টাকায়। ২০১৫ সালে তা এক লাফে বেড়ে ৪ হাজার ১ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। জালিয়াতির মাধ্যমে বের করে নেওয়া ঋণের অর্থ ফেরত না আসায় সেগুলো খেলাপি হতে থাকে। এতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ২০১৭ সালে তা বেড়ে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। ওই সময়ে পি কে হালদারের জালিয়াতির ঋণ খেলাপি হতে থাকে। তিনি চারটি ফাইন্যান্স কোম্পানিতে জালিয়াতি করে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছেন। এর প্রভাবে ২০১৮ সালে খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ২০২০ সালে প্রথম খেলাপি ঋণ ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। ২০২১ সালে ছাড়ায় ১৩ হাজার কোটি টাকা। ২০২২ সালে খেলাপি ঋণ বেড়ে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা হয়। ২০২৩ সালে আরও বেড়ে সাড়ে ২১ হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করে। গত জুনে তা আরও বেড়ে ২৪ হাজার ৭১১ কোটি টাকায় দাঁড়ায়।

আপনার সামাজিক মাধ্যমে খবরগুলো শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved © 2024
Developed BY www.budnews24.com