চালের বাজার স্থিতিশীল ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে সারা দেশে অভিযান শুরু করেছে সরকার। অবৈধ মজুতের অভিযোগে এরই মধ্যে শতাধিক প্রতিষ্ঠানকে ১০ লাখেরও বেশি টাকা জরিমানা করেছে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এ ছাড়া ধানের জাতের অস্তিত্ব না থাকা সত্ত্বেও মিনিকেট চালের বাজারজাত বন্ধেও পদক্ষেপ নিচ্ছে সংস্থাটি। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগেও দেশজুড়ে এ অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
সম্প্রতি ‘বিক্রি অব্যাহত মিনিকেট চাল, প্রতারিত হচ্ছেন ভোক্তা’ শিরোনামে আমার দেশে প্রতিবেদন প্রকাশের পর নড়েচড়ে ওঠে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সংস্থাটি এরই মধ্যে মিনিকেট চাল বাজারজাতের সঙ্গে যুক্ত কোম্পানিগুলোকে কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠিয়েছে।
এ বিষয়ে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান বলেন, খাদ্যবিভাগের খাদ্যতালিকায় মিনিকেট চালের কোনো উল্লেখ নেই। এ ছাড়া এ ধরনের ধানেরও কোনো অস্তিত্ব নেই। অথচ বেশ কিছু কোম্পানি মিনিকেট চাল বাজারজাত করছে। আমরা এরই মধ্যে তাদের নোটিস পাঠিয়েছি। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আমরা কঠোর অবস্থানে রয়েছি। এ ছাড়া বিশেষ ক্ষমতা আইনে বাজার সিন্ডিকেট বন্ধে রাইস মিল মালিকদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার এখতিয়ার সরকারের আছে।
গত ৭ জুলাই রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে খাদ্য নিরাপত্তাবিষয়ক সেমিনারে অন্তর্বর্তী সরকারের খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেন, চালের দাম কিছুটা বেড়েছে। আর যেন না বাড়ে, তা নিয়ে নজরদারি চলছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এবার দেশে বোরো ধান ফলনে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। দুই কোটি ১৪ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়েছে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারেও চালসহ দানাদার খাদ্যপণ্যের দাম নিম্নমুখী। এরপরও দেশে চালের বাজার অস্থির। বোরোর ভরা মৌসুমে হঠাৎ কেজিতে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন সাধারণ ভোক্তারা।
এ প্রসঙ্গে ভোক্তা ও সাধারণ ব্যবসায়ীরা জানান, নতুন ধান উঠতে না উঠতেই প্রায় সব ধরনের চালের দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে বাজারে সিন্ডিকেট জড়িত। বিশেষ করে দেশের ধান-চালের বাজার এখন অটো রাইচ মিল ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর দখলে চলে যাওয়ায় এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে চালের বাজার স্থিতিশীল ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে সরকার দেশে অভিযান শুরু করেছে। গত বুধবার এক বিজ্ঞপ্তিতে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ৪৪ জেলার বাজারে অভিযান চালিয়ে ১৩৮টি প্রতিষ্ঠানকে ১০ লাখ ৪ হাজার টাকা জরিমানা করেছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকাতে অধিদপ্তরের ১০ জন কর্মকর্তার নেতৃত্বে ১০টি টিম ঢাকা মহানগরীর যাত্রাবাড়ী, মালিবাগ, লালবাগ, মধ্য বাড্ডা, মোহাম্মদপুর বাজার, টাউন হল বাজার, মিরপুর-১০, ষাট ফিট এলাকায় বাজার তদারকি কার্যক্রম পরিচালনা করেছে।
বাজার তদারকিতে ঢাকা মহানগরীতে ভোক্তা অধিকারবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২২টি প্রতিষ্ঠানকে এক লাখ ২৮ হাজার টাকা জরিমানা আরোপ ও আদায় করা হয়েছে। এ ছাড়া দেশের ৪৪টি জেলায় অধিদপ্তরের ৬৩টি টিম পরিচালিত বাজার তদারকিতে মোট ১৩৮টি প্রতিষ্ঠানকে ১০ লাখ ৪ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। বগুড়া নওগাঁ ও দিনাজপুরসহ কয়েকটি জেলায় বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু অবৈধ মজুতের গুদাম সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাবের সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, অন্য সময় ধাপে ধাপে ১-২ টাকা করে চালের দাম বাড়লেও, এবার ভরা মৌসুমে হঠাৎ করে দাম বেড়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা ধানের দাম, শ্রমিক খরচসহ নানা অজুহাতে দাম বাড়াচ্ছেন।
সিন্ডিকেটের হাতে নিত্যপণ্যের বাজার জিম্মি উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও ব্যবসায়ীদের মানসিকতা বদলায়নি। তারা খোলস পরিবর্তন করেছে মাত্র। বাজার সিন্ডিকেট একই রয়ে গেছে। গুটিকয়েক অসাধু ব্যবসায়ী বাজারকে অস্থির করে তুলছে।
ক্যাবের সহসভাপতি আরো বলেন, সরকার চাল আমদানির অনুমতি দিলেও পর্যাপ্ত পরিমাণে আমদানি হয় না। সরকার চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে শুল্ক কমিয়েছে, আমদানির অনুমতি দিয়েছে। তবে অনুমতির চার ভাগের এক ভাগ চালও আমদানি হয়নি। কারণ সিন্ডিকেটে মূলহোতাদের বেশির ভাগই আমদানিকারক।
চালের বাজারে তদারকি বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, সবজি, মাংসসহ অন্যান্য পণ্যের বাজারে যেমন নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হয়, চালের বাজারে তেমনটা হয় না। এখানে ভোক্তা অধিকারসহ সরকারের অন্য সংস্থাগুলোর মনিটরিং বাড়াতে হবে।
মিনিকেট চাল প্রসঙ্গে ক্যাব নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিগত সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ চাল বাজারজাত করা নিষিদ্ধও করা হয়েছিল। কিন্তু সিন্ডিকেটের কারণে সেটি আর কার্যকর করতে পারেনি। প্রকাশ্যে গোটা জাতি কিছু কোম্পানির মাধ্যমে প্রতারিত হচ্ছে।