রাজধানীর পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের সামনে প্রকাশ্যে পাথর দিয়ে ব্যবসায়ী লাল চাঁন ওরফে সোহাগকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় উত্তাল হয়ে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) এবং বুয়েট ক্যাম্পাস। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত টানা বিক্ষোভ ও মিছিল করেছে চারটির অধিক ছাত্র সংগঠন, ঢাবির সাধারণ শিক্ষার্থী, এমনকি বুয়েটের শিক্ষার্থীরাও।
ঢাবির সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
শুক্রবার রাত ৮টার দিকে ঢাবির হলপাড়া থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তারা রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে গিয়ে অবস্থান নেন। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠন যুবদলের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ তোলেন, স্লোগানে তারা বলেন, “অ্যাকশন টু অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন; যুবদলের অনেক গুণ, পাথর মেরে সোহাগ খুন!” “আমার ভাই মরলো কেন? তারেক রহমান জবাব দে!”
ঢাবি শিক্ষার্থী এবি জুবায়ের বলেন, “জাতীয়তাবাদী চাঁদাবাজদল একজন ব্যবসায়ীকে চাঁদা না দেওয়ায় পাথর মেরে হত্যা করেছে। এটা শুধু বর্বরতা না, এটা সভ্যতা ধ্বংসের ঘোষণা।”
ছাত্র অধিকার পরিষদের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ
শুক্রবার রাত ৮টায় তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দিয়ে বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, “বিএনপি এখন তাদের নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। যারা ১৬ বছর ধরে নিজেদেরকে মজলুম দাবি করেছে, আজ তারাই সবচেয়ে বড় জালিম হয়ে উঠেছে।”
তিনি বলেন, “এই দশ মাসে বিএনপি শতাধিক মানুষকে খুন করেছে- এটা গণতান্ত্রিক মুক্তির চেতনার সম্পূর্ণ বিপরীত।”
ছাত্র ফেডারেশনের মশাল মিছিল
শুক্রবার রাতে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন ঢাবি ক্যাম্পাসে মশাল মিছিল করে প্রতিবাদ জানায়। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক সৈকত আরিফ বলেন, “জুলাই অভ্যুত্থানের পর মানুষের প্রত্যাশা ছিল নিরাপদ বাংলাদেশ, কিন্তু এখন খুন-ধর্ষণ-চাঁদাবাজিতে দেশ ভরে গেছে।”
বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় তিনি বলেন, “দলীয় বহিষ্কারই যথেষ্ট নয়, অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।”
ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের সরব অবস্থান
টিএসসি চত্বরে ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখাও বিক্ষোভ মিছিল করে। সংগঠনটির নেতা ইমরান হোসাইন নূর বলেন, “চাঁদা না দেওয়ায় একজন ব্যবসায়ীকে জনসমক্ষে হত্যা করা হয়েছে। এই বিচারহীনতার জন্য শুধু বিএনপি নয়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও দায় এড়াতে পারে না।” তাদের চার দফা দাবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মিডফোর্ড হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার, দেশব্যাপী সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং ইনসাফ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক সংস্কার।
বুয়েটে বিক্ষোভ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও শুক্রবার রাত ১০টায় বুয়েট শিক্ষার্থীরাও আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। তারা মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ক্যাম্পাস থেকে মিছিল বের করে। মিছিলটি শহীদ মিনার হয়ে ঘুরে বুয়েট ক্যাম্পাসে গিয়ে শেষ হয়। শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বলা হয়, “এই বর্বরতাকে কোনোভাবেই সভ্য সমাজে স্থান দেওয়া যায় না।”
ছাত্রদলের বিক্ষোভ মিছিল
শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ঢাবি শাখা ছাত্রদল একটি পৃথক বিক্ষোভ মিছিল করে এবং হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচার দাবি করে।
এসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস বলেন, পাঁচ আগস্ট পরবর্তী সময়ে আমরা যে রাজনীতির স্বপ্ন দেখেছিলাম তা ব্যাহত করেছে ইন্টেরিম সরকার। অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে আমরা যে জননিরাপত্তা আশা করেছিলাম তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
তিনি বলেন, নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় না আশার কারণে দেশের এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আইনশৃঙ্খলার এমন অবনতি হয়েছে।
এসময় তারা হত্যাকাণ্ডে জড়িত অপরাধীদের বিচার দাবি করেন।
হত্যাকাণ্ড ও তদন্ত: কী বলছে পুলিশ
কোতোয়ালি থানার ওসি মো. মনিরুজ্জামান বলেন, “ঘটনাটি ৯ জুলাই সন্ধ্যায় ঘটে। ব্যবসার দখল নিয়ে পূর্বপরিচিতদের সঙ্গে বিরোধের জেরে সোহাগকে হত্যা করা হয়েছে।” পুলিশ ইতোমধ্যে মাহমুদুল হাসান মহিন ও তারেক রহমান রবিনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়েছে। রবিনের কাছ থেকে একটি অবৈধ পিস্তলও উদ্ধার করা হয়েছে। মামলায় ১৯ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ১৫-২০ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, সোহাগকে একাধিক ব্যক্তি প্রকাশ্যে মারধর, লাথি এবং পাথর ছুঁড়ে হত্যা করেন। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরও তার লাশের উপর লাফিয়ে উঠতে দেখা যায় হামলাকারীদের। ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর জনমনে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়।