৫৪ বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম মাহে রমজানে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল ছিল। এর সুফলও ভোগ করেছে দেশের সাধারণ মানুষ। ওই সময় সরকার বেশকিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করায় এমনটি সম্ভব হয়েছিল মনে করেন ভোক্তা ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বাজার-সংশ্লিষ্টরা। এ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সামনের দিনগুলোতে বাজার দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীল রাখতে বেশকিছু উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার।
এর মধ্যে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে গড়ে ওঠা বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া, সুনির্দিষ্ট কিছু কোম্পানির কাছে যাতে দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি না থাকে, সেজন্য নতুন ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন পণ্য আমদানির অনুমতি প্রদান, বাজার মনিটরিং, নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়মিত মতবিনিময় এবং ভোক্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাসহ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে নানামুখী উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বাজার মনিটরিং ছাড়াও চাল, ডাল, ডিম, ভোজ্যতেল, চিনিসহ নিত্যপণ্যের সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য ‘জাতীয় বাজার স্থিতিশীলতা কমিশন (এনবিএসসি)’নামে নতুন একটি স্থায়ী কমিশন গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
প্রস্তাবক হিসেবে এ কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, দেশে চাল, ডাল, চিনি, ভোজ্যতেল, লবণ, মুরগি, গরুর মাংস, ডিম, মাছ, আলু, পেঁয়াজ, সবজি ও সারে সিন্ডিকেট করা হয়। ফলে কমিশন গঠনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বাজার ব্যবস্থাপনাকে সুষ্ঠু, কার্যকর ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। বাজারে মূল্য, সরবরাহ ও চাহিদা সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করবে এ কমিশন। সিন্ডিকেট ও অবৈধ ব্যবসায়িক কার্যক্রম রোধও এ কমিশন করবে। সার্বিক বিবেচনায় বাজারে স্থিতিশীলতা আনার জন্যই কমিশনটি গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত কমিশনকে ‘জাতীয় উদ্যোগ’হিসেবে বিবেচনা করে বলা হয়, দেশের বাজার ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘদিন ধরেই অসংগতিপূর্ণ, অবৈধ সিন্ডিকেট ও মূল্য কারচুপি বিরাজ করছে, যা জনস্বার্থের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। ভোক্তা সুরক্ষায় অবহেলা, বাজারে অস্থিতিশীলতা ও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া বাজারের কার্যক্রম তদারক, প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টি, মজুত নিয়ন্ত্রণ, বাজারে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয় থাকবে প্রস্তাবিত কমিশনটির আওতায়।
গত ২৩ জানুয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধিদলের মধ্যে প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এরপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত ১৬ মার্চ সম্ভাব্য কমিশনের রূপরেখার ওপর মতামত দিতে চারটি প্রতিষ্ঠান, যথাক্রমেÑ বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি), বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে কাছে চিঠি পাঠায়। ১০ এপ্রিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দ্বিতীয় দফায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ বিষয়ে মতামত দেওয়ার অনুরোধ করে। তবে এ কমিশনের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো আগ্রহী নয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে।
স্থিতিশীলতাবিষয়ক কাজের জন্য প্রতিযোগিতা কমিশন উপযুক্ত সংস্থা নয় উল্লেখ করে কমিশন গঠনের পক্ষে কয়েকটি যুক্তি তুলে ধরা হয়। এতে আরো বলা হয়, যারা নিয়মিত ন্যায্য দামে পণ্য বিক্রি করবে, তাদের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকবে আর যারা সিন্ডিকেটে জড়িত থাকবে, লাইসেন্স বাতিলের পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাও করা হবে।
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে জানানো হয়, ব্রাজিল থেকে ৪৫ টাকায় চিনি কিনে ৩০ টাকা শুল্ক যুক্ত হওয়ার পর দাম পড়ে ৭৫ টাকা। অথচ বাজারে এর দাম ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি। প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রতি কেজি চিনি ৫৩ রুপি, যার দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭৫ টাকা। এ বিষয়ে প্রতিযোগিতা কমিশনের কার্যক্রম দৃশ্যমান করা উচিত।
কমিশন গঠনের অগ্রগতি সম্পর্কে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান গত মঙ্গলবার বিকালে আমার দেশকে বলেন, প্রস্তাবিত নতুন কমিশন গঠনের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে মতামতের জন্য যে চিঠি পাঠানো হয়েছিল, তার জবাব আসছে কি না, তা খোঁজ নিয়ে জানাতে পারব। এছাড়া এ বিষয়টি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন সরকার বলেন, সরকার সিন্ডিকেটকে সাপোর্ট করে না। সার্বিক বাজার ব্যবস্থা দুর্বৃত্তায়ন থেকে বের হয়ে বাজারে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। মাহে রমজানে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিল, তা সফল হয়েছে। তাই মাহে রমজানের মতো কর কিংবা শুল্ক রেয়াত ছাড়া সম্ভাব্য সব এবং নতুন পদক্ষেপ আবারও গ্রহণ করা হচ্ছে, যাতে দীর্ঘমেয়াদে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা যায়।
এ বিষয়ে টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ ফয়সল আজাদ এক অনুষ্ঠানে বলেন, দ্রব্যমূল্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরাসরি টিসিবি আমদানি করবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে টিসিবি। এছাড়াও সাবানসহ আরো ৫ থেকে ৭টি পণ্য টিসিবি ভোক্তাদের কাছে বিক্রির চিন্তাভাবনা করছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান আমার দেশকে বলেন, ভোক্তার অধিকার আইন অনুযায়ী আমরা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনিক ক্ষমতাবলে যতটুকু করণীয়, সে বিষয়ে ভূমিকা পালন করছি। এর সুফলও পাচ্ছেন ভোক্তারা। এই অধিদপ্তর সারা দেশেই তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। এছাড়াও ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের বলেও জেলা প্রশাসকরা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিতে পারেন।
এ প্রসঙ্গে রাজশাহী জেলা প্রশাসক আফিয়া আখতার বলেন, সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বাজার মনিটরিং, নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময়সহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। এছাড়াও দ্রব্যমূল্যে ভোক্তাদের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেলে আইনের মধ্য থেকে আমরা সম্ভব সব ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছি।