জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে দুটি বিভাগ গঠনে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বিভাগ গঠনের আগে কার্যক্রম (অ্যালোকেশন অব বিজনেস), সাংগঠনিক কাঠামো (অর্গানোগ্রাম) তৈরি, ক্যাডার পদসমূহের পুনর্বিন্যাসসহ (কম্পোজিশন) বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই অধ্যাদেশ অনুযায়ী দুটি বিভাগ গঠন করতে হবে। বিভাগ গঠিত হলে এনবিআরের বর্তমান জনবলের তুলনায় অধিকসংখ্যক জনবল নিয়োগের সুযোগ তৈরি হবে এবং দেশের রাজস্ব আদায় কার্যক্রমে বেশি গতিশীলতা তৈরি হবে।
এদিকে এনবিআর বিলুপ্ত হয়ে দুটি বিভাগ গঠিত হলেও প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের দুশ্চিন্তার কারণ নেই বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, সব দেশেই এমন আলাদা বিভাগ থাকে। এনবিআরের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করেই এটি করা হয়েছে।
এনবিআর বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে দুটি পৃথক বিভাগ গঠনে গত সোমবার গভীর রাতে অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। তবে গত কয়েকদিন ধরেই অধ্যাদেশ জারি নিয়ে এনবিআর কর্মকর্তাদের মধ্যে বিভিন্ন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল। বিশেষ করে খসড়া অধ্যাদেশে প্রশাসন ক্যাডার থেকে জনবল নিয়োগের বিধান, কর ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরীক্ষণ ক্ষমতা করনীতি বিভাগের ওপর ন্যস্ত রাখাসহ বেশকিছু বিষয়ে আপত্তি ছিল রাজস্ব ক্যাডারের কর্মকর্তাদের। এ নিয়ে এনবিআরের কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ তৈরি হয়। তাদের সে আপত্তিগুলোকে আমলে নিয়ে সংশোধন করেই অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। জারিকৃত অধ্যাদেশে কর্মকর্তাদের মতামতের প্রতিফলন ঘটেছে বলে জানিয়েছেন দুই রাজস্ব অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি।
বিসিএস (ট্যাক্সেস) অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সদ্য সদস্য হিসেবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত ব্যারিস্টার মুতাসিম বিল্লাহ ফারুকী আমার দেশকে বলেন, জারিকৃত অধ্যাদেশে আমাদের যে আকাঙ্ক্ষা ছিল, তার প্রতিফলন ঘটেছে। খসড়া অধ্যাদেশে রাজস্ব বিষয়ে স্পষ্ট সংজ্ঞা ছিল না, এখন তা স্পষ্ট করা হয়েছে। প্রশাসন ক্যাডার থেকে জনবল নিয়োগ নিয়ে আপত্তি আমলে নিয়ে সেটিও সংশোধন করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, অর্থ উপদেষ্টা আমাদের আপত্তি ও দাবিগুলো মেনে নিয়ে খসড়া অধ্যাদেশে প্রয়োজনীয় সংশোধন এনেছেন। এজন্য আমরা তাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। অধ্যাদেশ জারি হলেও এর সঠিক বাস্তবায়নই আগামীদিনের চ্যালেঞ্জ বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বিসিএস (কাস্টমস ও ভ্যাট) অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও এনবিআর সদস্য কাজী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দুয়েকটি বিষয় ছাড়া আমাদের পক্ষ থেকে সেসব সুপারিশ ছিল, অধ্যাদেশে সেগুলোর প্রতিফলন ঘটেছে। তারপরও সবাই হয়তো সন্তুষ্ট নাও হতে পারে। প্রয়োজনে পরবর্তীতে সেগুলো সংশোধন করা যেতে পারে।
তবে দুই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির এমন সন্তুষ্টির মধ্যেই এনবিআরের মধ্যম সারির কর্মকর্তারা অধ্যাদেশ নিয়ে তাদের বড় ধরনের অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন। তারা বলছেন, অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা না করে, এমনকি পরামর্শক কমিটির সুপারিশকে আমলে না নিয়েই অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। এতে এনবিআর সংস্কারের লক্ষ্য অর্জিত হবে না। এজন্য তারা জারিকৃত অধ্যাদেশ বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। দাবি আদায়ে ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’ নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। যদিও এ কমিটির নেতৃত্বে কে রয়েছেন এবং কমিটির সদস্য ক’জন তা এখনও নির্ধারিত হয়নি।
ঐক্য পরিষদের সঙ্গে সম্পৃক্ত এনবিআরের অতিরিক্ত কমিশনার সাধন কুমার কুণ্ডু বলেন, শুধুমাত্র বিসিএস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিয়ে আমাদের দুটি অ্যাসোসিয়েশন ছিল। এখন আমরা সব শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে ‘এনবিআর ঐক্য পরিষদ’ গঠন করেছি। গঠিত পরিষদে নির্দিষ্ট কোনো নেতা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা সবার সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছি।
এদিকে ঐক্য পরিষদ অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে আজ বুধবার থেকে শনিবার পর্যন্ত তিন দিনের কলমবিরতির ডাক দিয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা, রপ্তানি কার্যক্রম ও জাতীয় বাজেট কার্যক্রম কলমবিরতির আওতার বাইরে থাকবে।
এনবিআর কর্মকর্তাদের এমন আন্দোলন কর্মসূচির বিরোধিতা করে এনবিআর সংস্কারে গঠিত পরামর্শক কমিটির সদস্য ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বলেন, যারা অধ্যাদেশ বাতিলের কথা বলছে, তারা আসলে সংস্কার চায় না। এনবিআরের দুই অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে এবং তাদের মতামতসহ আমরা আমাদের সুপারিশ সরকারের কাছে দিয়েছি। পরবর্তীতে খসড়া অধ্যাদেশে সেসব সুপারিশের ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছিল। কিন্তু সরকার যে অধ্যাদেশ জারি করেছে, তাতে দুয়েকটি শব্দের এদিক-ওদিক ছাড়া আমাদের সুপারিশের প্রতিফলন ঘটেছে। অধ্যাদেশে এনবিআরের কর্মকর্তাদের পেশাগত অধিকার সংরক্ষণ করা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এনবিআর সংস্কারে গত ৯ অক্টোবর সরকার পাঁচ সদস্যের পরামর্শক কমিটি গঠন করে। পরামর্শক কমিটি এনবিআর বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব প্রশাসন নামে দুটি পৃথক বিভাগ গঠনের সুপারিশ করে। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে বিভাগ গঠনে অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশ জারি করেছে।
এদিকে অধ্যাদেশ জারি হলেও এখনই এনবিআর বিলুপ্ত হচ্ছে না। পৃথক দুটি বিভাগ গঠিত হওয়ার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম বাস্তবায়নে পৃথক বিভাগের কার্যক্রম শুরু করতে আলাদা একটি গেজেট প্রকাশ করা হবে। ওই গেজেট প্রকাশের পরই এনবিআর বিলুপ্ত হবে। এটি বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ বলে জানিয়েছেন এনবিআরের কর্মকর্তারা। তারা বলেন, সহসাই বিভাগ গঠিত হবে, তেমন নয়। এজন্য সময় লাগবে। সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি বছরের মধ্যে বিভাগ চালু করা সম্ভব হতে পারে।