সোমবার, ১২ মে ২০২৫, ১২:৪৬ অপরাহ্ন

বিএসইসিতে অচলাবস্থা শেয়ারবাজারে দুর্দশা

  • সময়: রবিবার, ১১ মে, ২০২৫, ১২.৪৭ পিএম
  • ৬ জন

শেয়ারবাজারে দুর্দিন-দুর্দশা কাটছেই না। ধারাবাহিক দরপতন ও তীব্র তারল্য সংকটে বিপর্যস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়েছে দেশের শেয়ারবাজার। প্রায় বিনিয়োগকারীশূন্য হয়ে পড়েছে ব্রোকারেজ হাউসগুলো। পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘশ্বাস ক্রমশ বাড়ছে। সংকট উত্তরণে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। বরং কমিশনের সঙ্গে কর্মকর্তাদের দ্বন্দ্ব, বিভেদ, অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতায় এক ধরনের অচলাবস্থা বিরাজ করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটিতে। বাজার পরিস্থিতি নাজুক হওয়ার পেছনে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কমিশনের অনভিজ্ঞতা ও বিএসইসির অভ্যন্তরীণ সংকটকে অন্যতম কারণ হিসেবেই দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে ক্রমাগত দরপতনের পরিপ্রেক্ষিতে পুঁজিবাজার নিয়ে বৈঠকে বসছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আজ রোববার প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় দুপুর ১২টায় এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ও পুঁজিবাজার উন্নয়ন কমিটির চেয়ারম্যান ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী ও বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন। একটি সম্মেলনে যোগ দিতে রাশেদ মাকসুদ যুক্তরাষ্ট্র সফরে রয়েছেন। তিনি ১২ মে থেকে কাতারে অনুষ্ঠিত আইএসকো সম্মেলনে যোগ দেবেন। ওই সম্মেলনের ফাঁকেই তিনি দেশে এসে উক্ত বৈঠকে যোগ দেবেন বলে আমার দেশকে জানিয়েছেন বিএসইসির কমিশনার আলী আকবর।

সংশ্লিষ্টরা জানান, শেখ হাসিনার আমলে দুর্নীতি, লুটপাট ও অবাধ অর্থ পাচারে দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। ব্যাংকিং খাতকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছিল, শেয়ারবাজারেও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ালেও পুঁজিবাজারে তার কোনো প্রভাব নেই। পুঁজিবাজার পরিস্থিতি উন্নয়নে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ অংশীজনদের নিয়ে দুই দফা বৈঠকসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও বাস্তবে তার কোনো সুফল বাজারে দেখা যাচ্ছে না।

ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর শেয়ারবাজারে গতি ফিরে এসেছিল। অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দায়িত্ব গ্রহণ ও বিএসইসির চেয়ারম্যান পদ থেকে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত ইসলামের পদত্যাগের ঘটনায় ডিএসই লেনদেন ৩০০ কোটি টাকা থেকে দুই হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয় এবং ডিএসইর প্রধান সূচক ছাড়িয়ে যায় ৬ হাজার পয়েন্ট। কিন্তু বিএসইসির চেয়ারম্যান পদে খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে নিয়োগ দেওয়ার পর থেকেই যেন উল্টোপথেই হাঁটছে শেয়ারবাজার। টানা দরপতনে ডিএসই সূচক নেমে এসেছে ৫ হাজার পয়েন্টের নিচে। তীব্র তারল্য সংকটে শেয়ারবাজারের দৈনিক লেনদেন ৩০০-৪০০ কোটি টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

খন্দকার রাশেদ মাকসুদ একজন ব্যাংকার হিসেবে সিটি ব্যাংক এনএ, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ও এনআরবিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু পুঁজিবাজার বিষয়ে তার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তার নিয়োগ নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন ওঠে। অবশ্য তাকে চেয়ারম্যান নিয়োগের আগে মাসরুর রিয়াজকে নিয়োগ দিয়েছিল সরকার। কর্মকর্তাদের বিরোধিতার মুখে তিনি যোগদানে অপারগতা প্রকাশ করলে রাশেদ মাকসুদকে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার।

বর্তমান পরিস্থিতিকে সার্বিক অর্থনৈতিক চিত্রের প্রতিফলনের চেয়ে খন্দকার রাশেদ মাকসুদ কমিশনের ব্যর্থতাকে বড় কারণ হিসেবে মনে করছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা। রাশেদ মাকসুদ কমিশনের পদত্যাগের দাবিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের একটি গ্রুপ প্রায় প্রতিনিয়ত মানববন্ধন ও সভা-সমাবেশ করছে।

বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, উচ্চ সুদ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তবে গত দুই-তিন মাসে উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমেছে, রিজার্ভ বেড়েছে, ডলারের বিনিময়হার স্থিতিশীল রয়েছে। যদিও আমানতের সুদের হার এখনো বেশি। অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটলেও শেয়ারবাজারে তার প্রভাব নেই। এজন্য বর্তমান কমিশনের ওপর আস্থার সংকটকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা খুবই আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে নীতি পরিবর্তন, বড় ধরনের জরিমানা এবং সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিনিয়োগকারী ও বাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানকে আস্থায় নিয়ে কাজ করতে হবে। বড় বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব জব্দ করা হয়েছে। ফলে বাজারে তার একটি প্রভাব পড়েছে। এক্ষেত্রে কমিশনের অনভিজ্ঞতার কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হলেও তারা ভালো মনোভাব নিয়ে কাজ করছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ডিএসইর সাবেক প্রধান নির্বাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক সালাউদ্দিন আহমেদ খান বলেন, কমিশনের চেয়ারম্যান ব্যাংকার হলেও পেশাগত জীবনে খুব বেশি সফলতা দেখাতে পেরেছেনÑ বিষয়টি এমন নয়। পুঁজিবাজার নিয়ে যার অভিজ্ঞতা নেই, তাকে কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়াটা সঠিক সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে মনে করার কারণ নেই।

এদিকে খন্দকার রাশেদ মাকসুদসহ কমিশনের পদত্যাগের দাবিতে গত ৫ মার্চ বিএসইসির কর্মকর্তারা চার ঘণ্টারও বেশি সময় তাদের অবরুদ্ধ করে রাখেন। চেয়ারম্যানসহ কমিশনারদের পদত্যাগের দাবিতে অনড় থেকে ৬ মার্চ একদিনের কর্মবিরতিও পালন করেন বিএসইসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অবরুদ্ধের ঘটনায় জাড়িত থাকার অভিযোগে বিএসইসির সাবেক নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমানসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ২৯ এপ্রিল মামলায় অভিযুক্ত ১৪ জনসহ ২১ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করে কমিশন। একযোগে কমিশনের ২১ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের ঘটনায় বিএসইসির কর্মকর্তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে নানা ভীতি ও শঙ্কা।

অবরুদ্ধের ওই ঘটনার জেরে গত ১৫ মার্চ বিএসইসিতে প্রেষণে জনবল নিয়োগে অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেন খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। কর্মকর্তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিএসইসির কর্মকর্তাদের ওপর থেকে নির্ভরতা কমানো প্রয়োজন বলে ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। মন্ত্রণালয় থেকে প্রেষণে জনবল নিয়োগে বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের এমন চিঠিতে কমিশনের স্বাতন্ত্র্য ক্ষুণ্ণ হওয়ার পাশাপাশি এটিকে সরকারের একটি বিভাগে পরিণত করার প্রয়াস হিসেবে দেখছেন অনেকে। ফলে বিএসইসির সার্বিক কর্মকাণ্ডে এক ধরনের অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। অত্যন্ত সংবেদনশীল পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থায় কমিশনের সঙ্গে অনেকটা মুখোমুখি অবস্থান তৈরি হয়েছে কর্মকর্তাদের।

অন্যদিকে বাজারে ক্রমাগত দরপতনে বিনিয়োগকারীরা তাদের পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনামলে অধ্যাপক এম খায়রুল হোসেন ও অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম (বর্তমানে কারান্তরীণ) কমিশনের দায়িত্ব থাকাকালীন দুর্নীতি, লুটপাট ও কারসাজির একটি অভয়ারণ্য গড়ে তোলা হয়েছিল। শেখ হাসিনার পতনের পর দক্ষ, অভিজ্ঞ ও সৎ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে কমিশন গঠন করা হবে বলে ধারণা করেছিলেন বাজার বিশ্লেষকরা। কিন্তু সাবেক ব্যাংকার খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়ায় তাদের সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। এ ছাড়া শেখ হাসিনার আমলে নিয়োগ পাওয়া ও তার অত্যন্ত বিশ্বস্ত মহসিন চৌধুরী এখনো কমিশনার হিসেবে বহালতবিয়তে রয়েছেন।

তবে রাশেদ মাকসুদের বিরুদ্ধে অনভিজ্ঞতার সমালোচনা থাকলেও কমিশনের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের দুর্নীতি বা অনিয়মের অভিযোগ কেউ তোলেননি। বরং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে কমিশন। শেখ হাসিনার শাসনামলে যেসব অনিয়ম, দুর্নীতি ও কারসাজির ঘটনা ঘটেছে এবং সেসব ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে অভিযুক্তদের বড় অঙ্কের জরিমানা করেছে কমিশন। যদিও এসব জরিমানা থেকে অর্থ আদায়ের কোনো তথ্য কমিশন প্রকাশ করেনি। অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কারণে খন্দকার রাশেদ মাকসুদ কমিশনের বিরুদ্ধে একটি গ্রুপ পরিকল্পিতভাবে শেয়ারবাজারে দরপতনের নেপথ্যে কাজ করছে বলেও কেউ কেউ মনে করছেন।

সার্বিক বিষয়ে জানতে বিভিন্ন সময় বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি বরাবরই কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করে আসছেন। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত চেয়ারম্যানকে খুদে বার্তা পাঠিয়ে তার মতামত জানতে চাওয়া হলেও সাড়া দেননি।

বিএসইসির মুখপাত্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিচালক আবুল কালাম বলেন, বর্তমান কমিশন শেয়ারবাজারে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করছে না। বাজার তার নিজস্ব গতিতে চলছে।

আট মাসে ৯০০ পয়েন্টের পতন

রাশেদ মাকসুদ চেয়ারম্যান হওয়ার পর সূচকের পতন হয়েছে প্রায় ৯০০ পয়েন্টের মতো। গত বছরের ১৮ আগস্ট যোগদানের দিন দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ছিল ৫ হাজার ৭৭৮ পয়েন্টে। কিন্তু এখন তা ৪ হাজার ৯০০ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।

আইপিও খরা

শেয়ারবাজারে গতি ফিরিয়ে আনতে নতুন কোম্পানির তালিকাভুক্তির বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। বাজারে বিনিয়োগযোগ্য কোম্পানির সংখ্যা কমে যাওয়ায় নতুন কোম্পানির তালিকাভুক্তি অপরিহার্য হয়ে উঠলেও গত আট মাসে কোনো আইপিও অনুমোদন দেওয়া হয়নি। এমনকি কোনো কোম্পানি আইপিওর জন্য আবেদনও জমা দেয়নি।

বিনিয়োগকারীশূন্য ব্রোকারেজ হাউস

ক্রমাগত দরপতনে ব্রোকারেজ হাউসগুলো প্রায় বিনিয়োগকারীশূন্য হয়ে পড়েছে। হাতেগোনা কয়েকজন বিনিয়োগকারী হাউসে এলেও বিনিয়োগে তাদের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে।

আপনার সামাজিক মাধ্যমে খবরগুলো শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved by BUD News 24-2025
Developed BY www.budnews24.com