ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কৃত্রিমভাবে কমাতে দেশের ৬১টি ব্যাংক শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সাড়ে ৮১ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ অবলোপন বা রাইট অফ করা হয়েছে। এর মধ্যে শীর্ষ ১০ ব্যাংকেরই অবলোপন করেছে ৪১ হাজার কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকের এক বিশেষ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নীতিমালা শিথিলের কারণে খেলাপি ঋণ অবলোপন বেড়েছে। ব্যাংকগুলো খেলাপি কমাতে এখন আগের চেয়ে ঋণ অবলোপনে ঝুঁকছে বেশি। কারণ দেশের ব্যাংক খাতে অস্বাভাবিক হারে খেলাপি ঋণ বাড়ছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংক খাতে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত পুঞ্জীভূত অবলোপন ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৮১ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে পুঞ্জীভূত অবলোপন ঋণের স্থিতি ছিল ৭১ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা। ফলে গত বছর খেলাপি ঋণ অবলোপন বাড়িয়েছে ব্যাংকগুলো ৯ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা।
ব্যাংকগুলো যদি মনে করে খেলাপি ঋণ উদ্ধারের কোনো বাস্তব সম্ভাবনা নেই, তবে তারা তাদের ব্যালেন্স শিট থেকে খেলাপি ঋণ সরিয়ে নিতে ‘অবলোপন নীতিমালা’ ব্যবহার করে। তারপর অবলোপন করা ঋণকে অফ-ব্যালেন্স রেকর্ডে পাঠানো হয়। এর ফলে ব্যাংকগুলো তাদের খাতায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম দেখাতে পারবে। তবে ব্যাংকের দায় থেকে যায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন গাইডলাইনে বলা হয়, দুবছর ধরে খেলাপি ও লোকসানে থাকা ঋণ এখন ব্যাংকগুলোর ব্যালেন্স শিট থেকে মওকুফের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আগে এই সময়সীমা ছিল তিন বছর। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংক আগের সময়সীমা পাঁচ বছর থেকে কমিয়ে তিন বছর করেছিল।
নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, ঋণদাতাদের পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত খেলাপি ঋণ অবলোপনের জন্য অর্থঋণ আদালতে মামলা করতে হবে না। আগে এর পরিমাণ ছিল দুই লাখ টাকা।
ব্যাংকগুলো মামলা না করেই মৃত ব্যক্তির নামে থাকা খেলাপি ঋণ অবলোপন করতে পারবে। আগে নিয়ম ছিল কোনো আইনি ব্যবস্থা না নিলে ঋণ অবলোপনের আগে ব্যাংকগুলোকে অর্থঋণ আদালত আইন ২০০৩-এর অধীনে মামলা করতে হবে।
শুধু রিটেইনড ডেফার্ড ইন্টারেস্ট কেটে খেলাপি ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালায় বলা হয়েছে, খেলাপি ঋণ অবলোপনের জন্য কোনো ঋণ হিসাব আংশিক অবলোপন করা যাবে না এবং পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন বাধ্যতামূলক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০০৩ সালে এ সুবিধা চালুর পর থেকে এ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর ব্যালেন্স শিট থেকে ৮১ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা অবলোপন করা হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ২৫ হাজার ৮৩২ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো ৫২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা, বিদেশি ব্যাংকগুলো দুই হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো ৬১৩ কোটি টাকা।
অবলোপনকৃত শীর্ষ ১০ ব্যাংকের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক একাই করেছে ৮ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা। এরপর রয়েছে অগ্রণী ব্যাংক ৫ হাজার ৬২৭ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংক ৫ হাজার ১২৬ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড ২ হাজার ৯৬৯ কোটি টাকা ঋণ অবলোপন করেছে।
এছাড়া বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সাউথইস্ট ব্যাংক ৩ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ৩ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা, প্রাইম ব্যাংক ৩ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা, দ্য সিটি ব্যাংক ৩ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা, ব্র্যাক ব্যাংক ২ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা এবং ব্যাংক এশিয়া ২ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা ঋণ অবলোপন করেছে।
শীর্ষ ১০ ব্যাংক ছাড়াও পূবালী ব্যাংক ২ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা, উত্তরা ব্যাংক ২ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা, এবি ব্যাংক ২ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংক ২ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা, আইএফআইসি ব্যাংক ২ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ২ হাজার ৯৭ কোটি টাকা, ওয়ান ব্যাংক ২ হাজার ৭২ কোটি টাকা এবং ইস্টার্ন ব্যাংক ২ হাজার ১৯ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণে বড় যেসব অনিয়ম হয়েছে, তার অনেকাংশই অবলোপন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের আড়াল করা হয়েছে।
এদিকে খেলাপি ঋণ অবলোপন বাড়লেও দেশের ব্যাংকগুলোতে ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে রেকর্ড ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা হয়েছে।