আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আর্থিক লেনদেন একটি অপরিহার্য বিষয়।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আর্থিক লেনদেন একটি অপরিহার্য বিষয়।
আর্থিক লেনদেন ও মুমিনের পরিচয় : সামাজিক জীব হিসেবে আমাদের একে অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়েই বেঁচে থাকতে হয়। ফলে মানুষের সঙ্গে আমাদের প্রায়ই অনেক ধরনের আর্থিক লেনদেন হয়ে থাকে। সাধারণভাবে এই লেনদেনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, আমানতদারিতা ও সততা হলো অন্যতম একটি মাপকাঠি।
আমরা জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে লেনদেন বা মুয়ামালাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। লেনদেনের মাধ্যমে জীবন যাপন করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। আর লেনদেন ছাড়া কারো পক্ষে সঠিকভাবে ইবাদত-বন্দেগি করাও অসম্ভব। দ্বিনের ইবাদত-বন্দেগি আমাদের জন্য সীমিত। কিন্তু মুয়ামালাত বা লেনদেনের পরিধি বা সীমা ব্যাপক বিস্তৃত। তাই ইসলামে মুয়ামালাত বা লেনদেনের গুরুত্ব অনেক বেশি। আমরা যেসব ইবাদত করি বা অধিকার বা দায়দায়িত্ব বিষয়ের মোকাবেলা করি, তা দুই ধরনের। এক. আল্লাহর হক, দুই. বান্দার হক। আল্লাহর হক সঠিকভাবে পালনে ব্যর্থ হলে তাঁর কাছে মার্জনা চেয়ে ক্ষমা পেতে পারি। কিন্তু বান্দার হক বা বান্দার সঙ্গে লেনদেনে ব্যর্থ হলে এই ত্রুটি বা গুনাহ আল্লাহ মাফ করবেন না। তাই বান্দার হক সঠিকভাবে আদায় করা বা লেনদেন ও কায়কারবারে স্বচ্ছ থাকার ব্যাপারে আল্লাহর রাসুল (সা.) সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার কোনো ভাইয়ের সম্মানহানির মাধ্যমে বা অন্য কোনো প্রকারে তার ওপর জুলুম করেছে, সে যেন আজই তার সঙ্গে লেনাদেনা সাফ করে নেয়। ওই দিন আসার পূর্বেই, যেদিন তার কাছে কোনো দিনার-দিরহাম (মানে টাকা-পয়সা) থাকবে না। সেদিন যদি তার কাছে কোনো নেক আমল থাকে তবে তার জুলুম পরিমাণ সেখান থেকে নিয়ে নেওয়া হবে এবং পাওনাদারকে আদায় করে দেওয়া হবে। আর যদি কোনো নেক আমল না থাকে তাহলে যার ওপর জুলুম করা হয়েছে তার পাপের বোঝা জুলুম অনুযায়ী তার ঘাড়ে চাপানো হবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৪৪৯)
আর্থিক লেনদেনে মুমিনের দায়িত্ব : আর্থিক লেনদেনের বেলায় একজন মুমিনের দায়িত্ব হচ্ছে সে সময়মতো আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করবে। লেনদেনের সময় ঠিক রাখবে, মানে ওয়াদা রক্ষা করবে, ব্যবসায় করলে ওজনে কম দেবে না, বিক্রির সময় মিথ্যা শপথ কাটবে না, পণ্যের সঠিক গুণ প্রকাশ করবে, প্রতারণা ও ধোঁকাবাজি করবে না, মজুদদারি করবে না ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে সততা, স্বচ্ছতা ও আমানতদারিতা রক্ষা করে চলবে। যে ব্যবসায়ী ওজনে কম দেয় তার সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা ওজনে কম দেয়।’
(সুরা : মুতাফফিফিন, আয়াত : ১)
যারা অন্যায়ভাবে বা প্রতারণামূলকভাবে মানুষের সম্পদ গ্রাস করে তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করবে না।’
(সুরা : নিসা, আয়াত : ২৯)
লেনদেন সঠিকভাবে না হলে বা তাতে অস্বচ্ছতা থাকলে মানুষের ইবাদতও কবুল হয় না। আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইবাদত-বন্দেগি করি, নামাজ পড়ি, রোজা রাখি এবং অন্যান্য ভালো আমল করি। তবে যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে বা অবৈধ পথে সম্পদ উপার্জন করে বা অস্বচ্ছ আর্থিক লেনদেন করে, আল্লাহ তার ইবাদত-বন্দেগি ও দোয়া কবুল করেন না। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘হে আমার রব, হে আমার রব! অথচ তার খাদ্য-পানীয় হারাম, পোশাক-পরিচ্ছদ হারাম, তাহলে কিভাবে তার দোয়া কবুল হবে?’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৯৮৯)
আর্থিক লেনদেন বা ঋণ পরিশোধে গড়িমসি করার
পরিণাম : আর্থিক লেনদেন বা ঋণের বেলায় আমাদের অনেকে ঋণ না দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করি। অনেক সময় তা পরিশোধে গড়িমসি করতে দেখা যায়। অনেকের মধ্যে আর্থিক সংগতি থাকা সত্ত্বেও তার মধ্যে গড়িমসি বা টালবাহানার দোষ পরিলক্ষিত হয়। এই গড়িমসি বা টালবাহানা সম্পর্কে ইসলাম সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘সচ্ছল ব্যক্তির ঋণ পরিশোধে টালবাহানা বা গড়িমসি করা অন্যায় বা জুলুম।’
(সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৪০০)
তিনি অন্যত্র বলেন, ‘যে সচ্ছল ব্যক্তি ঋণ পরিশোধে গড়িমসি করে, তাকে অপমান ও শাস্তি উভয়টিই দেওয়া আমার কাছে হালাল।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৬২৮)
মহানবী (সা.) আরো বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি তার হাত দিয়ে যা গ্রহণ করেছে, তা পরিশোধ না করা পর্যন্ত সে দায়ী থাকবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১২৬৬)
সঠিক সময়ে ঋণ পরিশোধের বিষয়টি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে তার বিলম্বে ঋণগ্রহীতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কিয়ামতের দিন সে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির আত্মা লটকে থাকে, যতক্ষণ না তার পক্ষ থেকে কেউ সেই ঋণ পরিশোধ করে দেয়।’
(ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৪১৩)
রাসুল (সা.) অন্যত্র বলেন, ‘যে ব্যক্তি একটি দিনার অথবা দিরহাম ঋণ রেখে মারা যাবে, কিয়ামতের দিন তাকে তার নেকি থেকে সেই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। কারণ সেখানে কোনো দিনার বা দিরহাম নেই।’
(ইবসে মাজাহ, হাদিস : ৫৫১৯)
শহীদের বেলায়ও ঋণের ব্যাপারে কোনো মাফ নেই। যেখানে বলা হয়েছে শহীদের সব গুনাহ মাফ করা হবে এবং তারা বিনা বিচারে জান্নাত লাভ করবেন। তার পরও শুধু ঋণের বিষয়টির মাফ নেই। তাই রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ঋণ পরিশোধের পাপ ছাড়া শহীদদের সব পাপ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৯১২)
ঋণের অর্থ পরিশোধ করার সময় খুশি হয়ে বেশি ফেরত দেওয়ার বিধানও ইসলামে রয়েছে। সাহাবি জাবের (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) আমার কাছ থেকে কিছু ঋণ নিয়েছিলেন। পরে যখন তা আমাকে ফেরত দেন, তখন আমার পাওনার চেয়েও বাড়িয়ে দিলেন।’
(আবু দাউদ, হাদিস : ৩৩৪৯)
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে লেনদেনের গুরুত্ব এবং তার সঠিক বিধান সম্পর্কে অবহিত হওয়ার তৌফিক দান করুন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক ও সাবেক অ্যাডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক পিএলসি.