সোমবার, ২১ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:১২ অপরাহ্ন

এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ ৩ বার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন

  • সময়: সোমবার, ২১ এপ্রিল, ২০২৫, ৮.৫৫ এএম
  • ৯ জন

প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ প্রশ্নে কিছুটা নমনীয় হয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন তার চূড়ান্ত প্রস্তাবে এক ব্যক্তি দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না বলে সুপারিশ করলেও ঐকমত্য কমিশন এ অবস্থান থেকে কিছুটা পিছু হটেছে। এক্ষেত্রে কমিশন কোনো ব্যক্তি তিনবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না, এমন বিষয়ে নীতিগত অবস্থান নিয়েছে।

গতকাল রোববার বিএনপির সঙ্গে সংলাপে ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে এমন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। দলটি তার দলীয় ফোরামে আলোচনা করে এ বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত জানাবে বলে কমিশনকে জানিয়েছে।

সংবিধান ও নির্বাচনব্যবস্থাসহ ছয়টি সংস্কার কমিশন গত ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। এতে সংবিধান ও নির্বাচনব্যবস্থাÑ দুটি কমিশনই প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সর্বোচ্চ দুই টার্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার প্রস্তাব করে। কোনো ব্যক্তি একাধিক্রমে হোক বা না হোক, দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না বলে প্রস্তাব দেওয়া হয়। বিএনপির পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ দুই টার্ম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাবের বিরোধিতা করা হয়েছে। দলটি ঐকমত্য কমিশনে লিখিত প্রস্তাবেও বিষয়টি স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে।

লিখিত প্রস্তাবের ভিত্তিতে বিএনপি গতকালসহ দুই দফা ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করেছে। জানা গেছে, গতকালের বৈঠকে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব থেকে কিছুটা সরে এসে একক ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ তিনবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করার প্রস্তাব বিএনপিকে দেন। জানা গেছে, সংবিধান সংস্কার কমিশনের সভাপতি আলী রীয়াজের এই প্রস্তাবে অনেকটাই ইতিবাচকভাবে সাড়া দিয়েছে বিএনপি। যদিও সংলাপে দলটি ঐকমত্য কমিশনকে জানিয়েছেÑ দলীয় ফোরামে আলোচনা করে বিষয়টি নিয়ে তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানো হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকালের বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। নতুন একটি প্রস্তাবও এসেছে। এখনো চূড়ান্ত কিছু হয়নি। আমরা আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার চেষ্টা করছি।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে বদিউল আলম মজুমদার তার প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সর্বোচ্চ দুই টার্ম করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের নতুন প্রস্তাব দিয়েছে। বিষয়টি দলীয় ফোরামে আলোচনা করে আমাদের সিদ্ধান্ত জানাব। অবশ্য ঐকমত্য কমিশন কী প্রস্তাব দিয়েছে, সে বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকারপ্রধান ও পার্টির প্রধান একই ব্যক্তিÑ এমন বিষয়ে আমরা দ্বিমত পোষণ করেছি। আমরা বিষয়টি উন্মুক্ত রাখতে প্রস্তাব দিয়েছি। এখানে অপশন চায় দল, এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দলের কাছে থাকাই অধিকতর গণতন্ত্র চর্চা মনে করে বিএনপি।

গতকাল ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দ্বিতীয় দিনের বৈঠকের বিরতিতে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে এ কথা জানান তিনি। পাঁচটি কমিশনের বিষয়ে পূর্ণাজ্ঞ আলোচনা শেষ না হওয়ায় আবারও বৈঠক করবেন বলে জানান তিনি।

সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সংসদ নেতা এবং পার্টির প্রধান একই ব্যক্তি হতে পারবে না বলে প্রস্তাব করেছে কমিশন। এর সঙ্গে বিএনপি একমত নয়। আমরা এটা ওপেন রাখতে বলেছি। অপশনটা পলিটিক্যাল পার্টির এবং মেজরিটি পার্টি অব দ্য পার্লামেন্টের। কারণ সেই মেজরিটি পার্টির নেতা আর সংসদীয় দলের নেতা; সেটা অন্য বিষয়, পার্লামেন্টের ভেতরের বিষয় নয়।

সালাহউদ্দিনের মতে, পার্টির যিনি প্রধান, তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন নাÑএই প্র্যাকটিসটা তো আমরা দেখি না। আমরা যদি ওয়েস্ট মিনস্টার টাইপ অব গভর্নমেন্ট দেখি, ব্রিটেনের বর্তমান প্র্যাকটিস দেখি, পার্টি চিফ প্রধানমন্ত্রী হন। এটা একটা ডেমোক্রেটিক প্র্যাকটিস, তাতে কোনো অসুবিধা নেই। সেটা পার্টির স্বাধীনতা, সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতা, ডেমোক্রেটিক প্র্যাকটিসের স্বাধীনতা। সুষ্ঠু ভোটে যে সংসদ নির্বাচিত হবে, সেখানে আমাদের মনে রাখতে হবে জনগণ কাকে চায়। জনগণ হচ্ছে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। সুতরাং সেটা পার্লামেন্ট মেম্বার ও মেজরিটি পার্টির ইচ্ছার ওপর নির্ভর করা উচিত।

নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার সুযোগ

ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে আংশিক পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছে বিএনপি, যেখানে বলা হয়েছেÑ অর্থ বিল, সংবিধান সংশোধনী বিল, আস্থা ভোট এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিল ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে সংসদ সদস্যদের নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার সুযোগ রাখার কথা বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে সালাহউদ্দিন বলেন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্যদের ক্ষেত্রে আমরা শুনেছি আস্থা বিল এবং অর্থ বিলের ক্ষেত্রে প্রায় সবাই একমত। রাষ্ট্র পরিচালনার সুবিধার্থে এবং সরকারের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার স্বার্থে আমরা চারটি বিষয় এখানে উল্লেখ করেছি– অর্থ বিল, সংবিধান সংশোধনী বিল, আস্থা ভোট এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্নÑ এই চারটি বিষয় বাদে সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে তাদের বক্তব্য এবং ভোট প্রদান করতে পারবেন। তাতে তাদের সংসদ সদস্যপদ বিলুপ্ত হবে না।

বিদ্যমান সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারেন না। সেখানে বলা আছে, কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হিসেবে কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি যদি ওই দল থেকে পদত্যাগ করেন বা সংসদে ওই দলের বিপক্ষে ভোট দেন, তাহলে সংসদে তার আসন শূন্য হবে।

এই বিধানের কারণে খোদ সংসদেই গণতন্ত্র চর্চা ব্যাহত হচ্ছে বলে মতপ্রকাশ করে আসছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সেজন্য ৭০ অনুচ্ছেদ পুরোপুরি বিলোপের দাবিও জানিয়ে আসছে বিভিন্ন সংগঠন।

১০০ নারী আসন সংরক্ষণের পক্ষে বিএনপি

সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা বলেছি, নারীদের (সংরক্ষিত) আসন সংখ্যা ৫০ থেকে ১০০-তে উন্নীত করার সুপারিশের ব্যাপারে আমরা একমত। কিন্তু সেটা বিদ্যমান পদ্ধতিতেই মনোনয়ন হবে, সেটা আমাদের প্রস্তাবে বলেছি।

তিনি বলেন, তবে আমরা বলেছি, আগামী পার্লামেন্ট গঠন করার পর যখন ৩০০ আসনে প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত হবে এবং সংসদে এ সংক্রান্ত সংশোধনী গৃহীত হয়ে বর্তমানের ৫০ এবং আরো ৫০ নিয়ে ১০০ গঠিত হবে, সেই ৪০০ সদস্যবিশিষ্ট সংসদে বিষয়গুলো বিস্তারিত আলোচনা করে কোন পদ্ধতিতে তার পরবর্তী সংসদে নারী আসনের নির্বাচনটা হবে, তখন সংসদে আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে। বর্তমানের জন্য বিদ্যমান পদ্ধতিই আমরা মনে করেছি যে সঠিক। নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ন্যূনতম বয়স ২১ বছর করার প্রস্তাবে বিএনপি দ্বিমত পোষণ করেছে বলে জানান সালাহউদ্দিন।

সালাহউদ্দিন জানান, সংসদের উচ্চকক্ষে আসন সংখ্যা ১০০-তে সীমাবদ্ধ রাখার বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হয়েছে বিএনপি। এক্ষেত্রে উচ্চকক্ষের নির্বাচন পদ্ধতি, কারা আসবে এবং আনুপাতিক হারে আসবে কি না, সে বিষয়ে বিএনপি বলেছে, আগে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের সংশোধনীটা সংসদে গৃহীত হোক, দ্বিকক্ষ গঠন হলে পরে সংসদে আলাপ করে নির্বাচন পদ্ধতি ঠিক করা ভালো হবে।

রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধির পক্ষে একমত

ক্ষমতার ভারসাম্যের জন‌্য রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধির প‌ক্ষে বিএনপি। এর জন‌্য সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদের পর আরেকটি অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হ‌বে পরবর্তী সময়ে সংস‌দে আলোচনার মাধ‌্যমে। রাষ্ট্রপতি সংস‌দের উভয়ক‌ক্ষের সদস‌্যদের ভো‌টেই নির্বাচিত হ‌বেন। সংস্কার ক‌মিশ‌নের সুপা‌রিশ অনুযায়ী ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’-এর মাধ্যমে রাষ্ট্রপ‌তি নির্বাচ‌নে একমত নয় বিএন‌পি।

সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা বলেছি রাষ্ট্রপতিকে কী কী বিষয়ে ক্ষমতায়িত করে আইন প্রণয়ন করা যায়, সেসব বিষয় এবং নিয়োগের কিছু বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি। সেগুলো নতুন আইন প্রণয়ন করে সংসদে প্রণীত করা যাবে। সেক্ষেত্রে চেক অ্যান্ড ব্যালান্স এবং রাষ্ট্রপতির আরো ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা হবে।

‘ন্যাশনাল কনস্টিটিউশন কাউন্সিল’ গঠনের প্রস্তাবে বিএনপি একমত নয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা একটা নতুন ধারণা বাংলাদেশের পলিটিক্যাল কালচারে বা সংসদীয় কালচারে, যেখানে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, উভয় কক্ষের স্পিকার এবং প্রধান বিচারপতিসহ আরো কয়েকজনের কথা বলা আছে। এই বডিটার হাতে রাষ্ট্রের সব গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগের ক্ষমতাÑ যেমন সব কমিশন, তিন বাহিনীর প্রধান থেকে শুরু করে পিএসসি, দুদকসহ আরো যেসব সাংবিধানিক পদ আছে, এগুলোতে আমরা একমত নই। কারণ আমরা মনে করি, তাতে রাষ্ট্রের এক্সিকিউটিভ ফাংশনটাকে এত বেশি লিমিট করা হবে যে, এক্সিকিউটিভ বা প্রধানমন্ত্রী যে নামেই ডাকি, তাদের রাষ্ট্র পরিচালনা দায় হয়ে যাবে। অথচ দায়িত্বটা থাকবে নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে জনগণের কাছে এবং সংসদের কাছে। অথচ তার কাছে তেমন কোনো পাওয়ার দেওয়া থাকল না।’

বিএনপি রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর রাখার পক্ষেই মত দিয়েছে বলে জানান সালাহউদ্দিন আহমেদ।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে সালাহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বিএনপির প্রতিনিধিদলে ছিলেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ইসমাইল জবিহউল্লাহ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল এবং সাবেক সচিব আবু মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে বৈঠকে কমিশনের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।

আপনার সামাজিক মাধ্যমে খবরগুলো শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved by BUD News 24-2025
Developed BY www.budnews24.com