দালালের খপ্পরে পড়ে বিদেশে সোনার হরিণের পেছনে যেন কেউ না ছোটে। সব হারিয়ে শুধু প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরেছি। দেশে ফিরতে পারব তা-ও কখনো ভাবিনি। কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন মাদারীপুরের ইয়াছিন হাওলাদার।
ভূমধ্যসাগরের উত্তাল ঢেউ, মৃত্যুর হাতছানি, বন্দিদশার নির্মমতা পেরিয়ে গতকাল শুক্রবার বাংলাদেশে ফেরা পাঁচজনের একজন ইয়াছিন। বাকিরা হলেন- ঢাকার মোস্তাকিম সরকার, শেরপুরের মোজাম্মেল হক, মাদারীপুরের জিহাদ ফকির ও রোমান হাওলাদার। গতকাল ভোর সাড়ে ৫টায় টার্কিশ এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে আলজেরিয়া থেকে তারা দেশে ফেরেন।
এরপর শাহজালাল বিমানবন্দরের ১ নম্বর টার্মিনালের বাইরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ইয়াসিন। তিনি জানান, ইতালিতে সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে দেশ ছেড়েছিলেন। কিন্তু দালালের প্রতারণায় তারা গিয়ে পৌঁছেন লিবিয়ায়। সেখানে তারা এক ভয়ংকর মানব পাচারকারী মাফিয়া চক্রের খপ্পরে পড়েন। নির্মম নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর তারা সাতদিন মরুভূমিতে শুধু খেজুর খেয়ে বেঁচে ছিলেন।
ইয়াসিন জানান, এক বছর আগে খালেদা নামে গ্রামের এক নারী তার কাছ থেকে সাড়ে ১৩ লাখ টাকা নেন বিদেশে পাঠানোর কথা বলে। তাকে সহায়তা করে শামছু ও রুবিনা বেগম। এরপর ইয়াছিন ঢাকায় এসে ইতালির উদ্দেশে যাত্রা করেন। ঢাকা থেকে প্রথমে দুবাই, এরপর মিসর হয়ে লিবিয়ার ত্রিপোলিতে পৌঁছান। দুবাই যাওয়ার পর তাদের কাছ থেকে মোবাইল, পাসপোর্ট নিয়ে নেওয়া হয়।
ইয়াসিন আরো জানান, এখানে মানবপাচার চক্রের সদস্যরা তাদের ওপর নির্যাতন চালান। নির্যাতনের দৃশ্য দেখিয়ে টাকা দাবি করা হয় পরিবারের কাছে। এরপর নেওয়া হয় তিউনিসিয়ায়। দেশ থেকে টাকা পাঠানোর পর তাদের ভূমধ্যসাগর হয়ে ইতালি যাওয়ার বোটে তুলে দেওয়া হয়। মাঝসাগরে নৌকা ফুটো হয়ে যায়। সমুদ্রের লবণ পানি ও পেট্রোল মিশে শরীরের বিভিন্ন অংশ ঝলসে যায়। এ সময় চিৎকার করতে থাকেন তারা। চিৎকার শোনার পর তিউনিসিয়ার কোস্ট গার্ড তাদের উদ্ধার করে।
এরপর মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয়েছে ইয়াসিনদের। তিনি জানান, মরুভূমিতে মাইলের পর মাইল অসুস্থ বন্ধুকে কাঁধে নিয়ে পাড়ি দিতে হয়। একসময় তাকে মরুভূমিতে গায়ে কাপড় দিয়ে ফেলে রেখে আসতে হয়েছে। হয়তো সে আর বেঁচে নেই। এরপর তাদের নেওয়া হয় আলজেরিয়া সীমান্তে। সেখানে তারা অনুপ্রবেশের দায়ে নানা মেয়াদে জেল খাটেন।
এক রকম মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরা ইয়াসিন বলেন, লিবিয়ায় মাফিয়ার কাছে আটক ছিলাম। দালালদের মোট ২৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা দিয়েছে আমার পরিবার। এখন আমার পরিবারের আর কিছুই নেই।
সেখানকার পরিস্থিতির কথা বলতে গিয়ে ইয়াসিন বলেন, সেখানে রয়েছে টর্চার সেল। সপ্তাহে চারদিন ডাল-ভাত দেওয়া হতো। বাকি তিনদিন কোনো খাবার দেওয়া হতো না। আমাদের পাঁচজনের মধ্যে তিনজন একই সেলে ছিলাম। বাকি দুইজন আসার সময় আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। দেশে ফেরার আগে আমরা ১৫ দিন হাপাতালে ভর্তি ছিলাম।
মোস্তাকিম সরকারকে নিতে এসেছিলেন তার স্ত্রী শারমিন আক্তার। কোলে ছয় মাসের শিশুসন্তান। তিনি বলেন, স্বামীর জন্য উপায়ন্তর না দেখে তিনি মুক্তিপণের ১২ লাখ টাকা তার বাবার বাড়ি থেকে নিয়েছেন। দালালদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, কিন্তু তাদের কোনো শাস্তি হয়নি।
এ পাঁচ বাংলাদেশিকে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড এবং আলজেরিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তায় দেশে ফিরিয়ে আনে।
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, সমস্যা সমাধানে সাধারণ মানুষ ও বিদেশগামীদের সচেতন হতে হবে। এলাকার স্থানীয় দালাল ও মানব পাচার চক্রকে চিহ্নিত করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সমন্বিত অভিযান চালাতে হবে। সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সিনিয়র ম্যানেজার আজিজ আহমেদ বলেন, এ পাঁচ বাংলাদেশির প্রত্যাবাসনের জন্য আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাফিকিং ইন পারসন্স হিরো নেটওয়ার্কের সহায়তা নিয়েছি।