শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ১১:০৮ অপরাহ্ন

স্বপ্ন দেখিয়ে জাতির ঘাড়ে শত বিলিয়ন ডলারের বিদেশি ঋণ

  • সময়: সোমবার, ২০ জানুয়ারী, ২০২৫, ১.৩৪ পিএম
  • ৫৭ জন

২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার স্বপ্ন দেখিয়ে রূপকল্প ঘোষণা করেছিল শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার। নানা কথামালার ফুলঝুরি আর পরিসংখ্যান জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থনীতির নানা সূচককে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়ে উন্নত রাষ্ট্রের অভীষ্ট লক্ষ্যে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে—এমন প্রচার-প্রপাগান্ডা ছিল তুঙ্গে।

শুধু আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাই নয়, সরকারের আমলারাও এ প্রচারে পিছিয়ে ছিলেন না। কিন্তু বাস্তবে ১৫ বছরের শাসনামলে দুর্নীতি, অর্থপাচার ও বিদেশি ঋণের ভারে দেশের অর্থনীতিকে দেউলিয়া হওয়ার দিকে নিয়ে গিয়েছেন শেখ হাসিনা। উন্নত দেশ গড়ার যে প্রত্যাশার কথা বলেছিলেন, সেগুলো ফাঁকা বুলি ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার সময় বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ২১ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু হাসিনার সরকার অপ্রয়োজনীয় নানা প্রকল্পে উদারহস্তে ঋণগ্রহণ করে ১০৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণের ভার এ দেশের সাধারণ জনগণের কাঁধে চাপিয়ে গেছে। অন্যদিকে অর্থপাচারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়েছে।

হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এরপর দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বিষয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে অর্থ পাচারের এক ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। হাসিনার আমলে ২৩৪ বিলিয়ন অর্থ পাচার হয়েছে বলে কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এ অর্থের পরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা। আবার বিদেশ থেকে যেসব ঋণ নেওয়া হয়েছিল, তার একটি অংশও পাচার হয়ে গেছে।

হাসিনার শাসনামলে দেশের অর্থনীতির পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমার দেশকে বলেন, অর্থনীতির সমৃদ্ধি নিয়ে যে স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল, তার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল ছিল না। সোনালি দিনের কথা বলে মিথ্যাচার করা হয়েছে। তথ্যের বিকৃতি ঘটিয়ে প্রবৃদ্ধি বেশি দেখানো হয়েছিল।

ব্যাংক খাত দুর্দশায় নিপতিত হয়েছিল। যখনই সংকটের মাত্রা বেড়েছে, তখনই মিথ্যাচার করে সংকটকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় বৈদেশিক ঋণ ও অর্থপাচারের ফলে বিগত হাসিনার শাসনামলে দেশের অর্থনীতি দেউলিয়া হওয়ার দিকে যাচ্ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।

অথচ ‘উন্নয়নের রোড মডেল’ আখ্যা দিয়ে দেশের অর্থনীতি দুর্বার গতিয়ে এগিয়ে যাওয়ার গল্প শুনিয়েছেন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা ও তার অনুসারীরা। হাসিনার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনার সময় সংসদে গর্বের সঙ্গেই বলেছিলেন, ‘২০৩০ সালের মধ্যে আমরা আর ঋণ নেব না, ঋণ দেব।’ এমনকি সারা বিশ্বের মানুষকে ঋণ দেয়ারও ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি।

কিন্তু লুটপাট, দুর্নীতি, পাচার আর বৈদেশিক ঋণের চাপে দেশের অর্থনীতিকে পর্যুদস্ত করে চার বছরের মাথায়ই ঋণের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দ্বারস্থ হন তিনি। সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারের ঋণ পাওয়ার জন্য আইএমএফের নানা শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হয় সরকার। শেখ হাসিনার আমলে পাচার হওয়া ২৩৪ বিলিয়ন ডলারের সঙ্গে তুলনা করলে আইএমএফের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ খুবই সামান্য। কিন্তু ওই সময় রিজার্ভ এতটাই খালি হয়ে গিয়েছিল যে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে আমদানি ব্যয় মেটানো, বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বকেয়া পরিশোধ ও বহুজাতিক কোম্পানির লভ্যাংশ পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছিল না।

দেশের ব্যাংক খাতকে ধসিয়ে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের আশীর্বাদপুষ্ট এক এস আলম গ্রুপের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে দেশের সাতটি বাণিজ্যিক ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটি নামে-বেনামে প্রায় হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠানের নামে কমপক্ষে দুই লাখ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।

এছাড়া শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ ৫০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। হাতিয়ে নেওয়া এসব অর্থের প্রায় পুরোটাই বিভিন্ন দেশে পাচার করেছেন। শেয়ারবাজার থেকে এক লাখ কোটি টাকা আত্মসাৎ হয়েছে বলে শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে। শুধু বন্ডের মাধ্যমে সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে বাজার থেকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ আমার দেশকে বলেন, লাগামহীন দুর্নীতি, লুটপাট ও অর্থ পাচারের কারণে আওয়ামী লীগ আমলে দেশের অর্থনীতি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। এখন সে অবস্থা থেকে উত্তরণই বর্তমান সরকারের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ১৫ বছরে অর্থনীতিতে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, তা সামাল দেওয়াই কঠিন।

উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের নেওয়া পরিকল্পনাগুলোর সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ অর্জনে যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা কীসের ভিত্তিতে অর্জিত হবে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই।

সংশ্লিষ্টরা জানান, উন্নত বিশ্বে পরিণত হওয়ার জন্য শুধু অর্থনৈতিক উন্নতিই নয়; আইনের শাসন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সামাজিক ন্যায়বিচার, আইনশৃঙ্খলাসহ আরও অনেক বিষয় জড়িত। কিন্তু গত ১৫ বছরে এসব সূচকের অধিকাংশেই অবনমন ঘটেছে।

আগামী ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটবে বাংলাদেশের। কিন্তু এ উত্তরণের ফলে অর্থনীতিতে যেসব চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে, সেগুলো মোকাবিলা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। এই উত্তরণ আমাদের জন্য একটি ফাঁদ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সময় আরও পিছিয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন।

আপনার সামাজিক মাধ্যমে খবরগুলো শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved by BUD News 24-2025
Developed BY www.budnews24.com