বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৫, ০৯:৩৫ অপরাহ্ন

ঋণখেলাপিদের ছাড় দেওয়ার উদ্যোগ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের

  • সময়: বুধবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২৫, ২.২৮ পিএম
  • ৫ জন

ঋণখেলাপিদের জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের মতো উদার নীতি দেখাতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারও। খেলাপি গ্রাহকদের ছাড় দিতে বিদ্যমান নীতিমালা পূর্ণ-পর্যালোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হককে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। দ্রুত এ-সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা দেওয়া হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে।

মেজবাউল হক ছাড়াও কমিটিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন দি ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) একজন প্রতিনিধি, সাবেক ব্যাংকার মামুন রশীদ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালক মোহাম্মদ শাহরিয়ার সিদ্দিকীকে সদস্য সচিব হিসেবে রাখা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র মোহাম্মদ শাহরিয়ার সিদ্দিকী আমার দেশকে বলেন, ‘এ-সংক্রান্ত একটি কমিটি হয়েছে। এই কমিটি বিদ্যমান সার্কুলারগুলো রি-ভিজিট করবে। এরপর যারা ক্ষতিগ্রস্ত তাদের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, তিনটি কার্যপরিধি সামনে রেখে এই কমিটি কাজ করবে। প্রথম. ঋণ শ্রেণিকরণ, পুনঃতফসিল এবং সুদ মওকুফ পলিসি সবগুলো পূর্ণ-পর্যালোচনা করা হবে। দ্বিতীয়. ২০ কোটি টাকার ওপরে যেসব খেলাপি ঋণ রয়েছে যারা নানাভাবে সমস্যাগ্রস্ত। এসব গ্রাহক আসল অর্থেই সমস্যাগ্রস্ত কিন্তু পলিসিগত কারণে ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারছেন না। তাদের বিষয়গুলোও পর্যালোচনা করা হবে। তৃতীয়. ইচ্ছাকৃত খেলাপি নন তাদের আবেদনও নেওয়া হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে সমস্যাগ্রস্ত গ্রাহকদের কাছ থেকে আবেদন নেওয়া হবে। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক সবকিছু যাচাই-বাছাই করে কমিটির কাছে পাঠাবে। কমিটি যদি মনে করে ছাড় দেওয়া উচিত তাহলে তাদের সুপারিশ অনুযায়ী ছাড় দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।’

এ ধরনের সিদ্ধান্ত মোটেও কাম্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী। আমার দেশকে তিনি বলেন, ‘বিগত সরকারের আমলে বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং সুবিধাভোগীদের ছত্রছায়ায় ঋণখেলাপির সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই সময় ঋণ পুনঃতফসিল ও সুদ মওকুফসহ নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছে। বর্তমান সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা ছিল যেসব কারণে ব্যাংকগুলোর ভঙ্গুর অবস্থা তৈরি হয়েছে, তাদের জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেবে, যাতে ব্যাংকগুলো ঋণখেলাপির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। কিন্তু বাস্তবে সে ধরনের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। বরং আগের মতোই দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তায় ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ আদায়ে উদ্যোগ নিচ্ছে না।’

তিনি বলেন, ‘এ সরকারের দরকার ছিল কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া। তাহলে ভবিষ্যতে ঋণখেলাপির প্রবণতা কমে যেত। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে যে সুযোগ এসেছিল তা নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে খেলাপি ঋণ সংস্কৃতিতে যারা অভ্যস্ত তারা উৎসাহিত হবে। এটা জাতির দুর্ভাগ্যজনক।’

উল্লেখ্য, এর আগে গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নানাভাবে ঋণখেলাপিদের ছাড় দেওয়া হয়। ২০০৯ সালে সরকার গঠন করার পর শুরুতে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। যেমন- ২০১২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলার জারি করে বলেছিল, কোনোভাবেই তিনবারের বেশি ঋণ পুনঃতফসিল করা যাবে না। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিমালাটিও ধরে রাখতে পারেনি। প্রভাবশালীদের তদবির ও চাপে পিছু হটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন করে তিন মাস সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়।

প্রভাবশালী ঋণখেলাপি ব্যবসায়ীদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটে ২০১৫ সালে। সে সময় খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের বিশেষ এক স্কিম হাতে নেওয়া হয়। তখন নিয়ম ছিল তিনবারের বেশি ঋণ পুনঃতফসিল করা যায় না। কিন্তু বেশির ভাগ প্রভাবশালী উদ্যোক্তাই তিনবার সুযোগটি নিয়েও খেলাপি হয়ে পড়েছিলেন। এরপরেই ঋণ পুনর্গঠন নামে নতুন এক সুবিধা দেওয়া হয়। এর আওতায় দেশের বড় ১১টি শিল্প গ্রুপের প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছিল। তারপরও এসব গ্রুপের বেশির ভাগই ঋণের কিস্তি আর পরিশোধ করেনি।

২০১৮ সালে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞার আবার বদল হয়। ঋণ পরিশোধের সময় আরও তিন মাস বাড়ানো হয়। একই সময় ঋণ অবলোপন বা রাইট অফের ক্ষেত্রেও বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়। তবে ২০১৯ সালে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দেশের ইতিহাসে ঋণখেলাপিদের জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধাটি দেন। সে সময় ২ শতাংশ কিস্তি দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ রাখা হয়। নতুন নিয়মে ঋণ পরিশোধের জন্য ১০ বছর সময় দেওয়া হয়, এর মধ্যে প্রথম এক বছর কোনো কিস্তি দিতে হয়নি। সেই সুযোগ নেওয়া বেশির ভাগই পরে খেলাপিতে পরিণত হয়েছেন।

দেশের ব্যাংকগুলোতে গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে নামে–বেনামে যে অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে, তা এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে। ফলে ব্যাংক থেকে বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশই বর্তমানে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।

আপনার সামাজিক মাধ্যমে খবরগুলো শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved © 2024
Developed BY www.budnews24.com