ইস্পাত বাজার হঠাৎ ঊর্ধ্বমুখী। এক মাসের ব্যবধানে টনপ্রতি রডের দাম বেড়েছে ৭ হাজার টাকা। এ সময়ে ব্যক্তিপর্যায়ে বাড়িঘর নির্মাণের কাজ বেড়ে যাওয়ায় চাহিদা বেড়ে রডের দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।
মিল মালিকরা বলছেন, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় রডের দাম বেড়েছে। তারা জানান, দাম বাড়লেও উৎপাদন খরচের সঙ্গে দামের সমন্বয় হয়নি বলে এখনও তাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। তবে সাধারণ ব্যবসায়ীরা এটাকে পরিকল্পিত কারসাজি বলে অভিযোগ করেছেন।
মোহাম্মদ মিলন নামে এক ক্রেতা বলেন, গত ১২-১৩ দিন আগে বিএসআরএম রডের দাম ছিল ৮৪ হাজার ৫০০ টাকা, আর গত রোববার রড কিনতে গিয়ে দেখি প্রতি টন বিক্রি হচ্ছে ৯১ হাজার ৫০০ টাকায়। কদিনের মধ্যেই ব্যবধান ৭ হাজার টাকার। এখানেই শেষ নয়, দোকানদার এটিও বলেছেন যে, কদিনের মধ্যে এক লাখের কাছাকাছি যাবে রডের দাম।
হালিমা স্টিল কর্পোরেশনের স্বত্বাধিকারী তরিকুল ইসলাম বলেন, কাঁচামাল তথা উৎপাদন খরচের সঙ্গে যে কোনো পণ্যের দাম বাড়ার সম্পর্ক থাকতে পারে। কিন্তু চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে দাম বাড়ার ঘটনা বড় ধরনের কারসাজি ছাড়া আর কিছুই নয়।
আর কেউ যদি ডলারের দামের অস্থিরতার কথাও উল্লেখ করতে চান, তাহলেও তো কেজিপ্রতি ২-৩ টাকা বাড়তে পারে; কিন্তু ৮-১০ টাকা বাড়ার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে রডের দাম বাড়ার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। দেশে সরকারি বড় বড় কাজ সব বন্ধ, নতুন কোনো কাজ নেই, ব্যক্তিপর্যায়েও কাজ কম।
বর্তমানে পরিকল্পিতভাবে সিন্ডিকেট করে রডের দাম বাড়ানো হচ্ছে। তিনি জানান, বর্তমানে ঢাকা অঞ্চলের কোম্পানিগুলোর পাইকারি ৭৫ গ্রেডের রড টনপ্রতি ৮৪ থেকে ৮৫ হাজার টাকা এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলের কোম্পানিগুলোর রড ৮৯ থেকে ৯১ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে খুচরা পর্যায়ে টনপ্রতি আরও ৩ হাজার টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
ঢাকার তেজতুরীবাজার এলাকার মুজাহিদ ট্রেডিংয়ের মালিক মুজাহিদুর রহমান বলেন, গত এক মাসে প্রতিটন রড ৭ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। দাম বাড়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দামে হেরফের না হলেও ডলারের দাম বাড়ার কারণে রডের দাম বেড়েছে- এমনটিই ধারণা করা হচ্ছে। ছয় মাসেরও বেশি সময় থেমে থাকার পর এক মাসে টনপ্রতি ৭ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা বাড়ার ঘটনা নজিরবিহীন উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের দেশে অনেক পণ্যের দাম রিউমারে বাড়ে, রডের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, টানা ছয় মাসেরও বেশি সময় স্থবির থাকার পর চাহিদা বাড়ার কারণে গত ৩-৪ সপ্তাহ ধরে ধাপে ধাপে নির্মাণপণ্য এমএস রডের দাম বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত সাধারণত ব্যক্তিপর্যায়ে বাড়িঘর বেশি নির্মাণ হয়। ফলে শুষ্ক মৌসুমে ব্যক্তিপর্যায়ে বাড়িঘর নির্মাণের কাজ বাড়ায় চাহিদা বেড়ে রডের দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। তবে সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পে রডের চাহিদা তেমন বাড়েনি। গত ৬ মাস ধরে সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পের কাজ নেই বললেই চলে।
তবে মিল মালিকরা জানান, বর্তমানে মিল পর্যায়ে প্রতিটন ৭৫ গ্রেডের এমএস রড বিক্রি হচ্ছে ৮৪ থেকে ৯১ হাজার টাকায়। এর আগে জুলাইয়ে ৯৫ হাজার টাকা দরে বিক্রি হওয়া রড ক্রমাগত কমে ডিসেম্বরে মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ৮০-৮২ হাজার টাকায় নেমে আসে। অন্যদিকে ২০২১ সাল থেকে দফায় দফায় বেড়ে ২০২২-২৩ সালে পণ্যটির দাম প্রতিটন এক লাখ টাকার ওপরে পৌঁছেছিল।
রড উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের মালিকরা বলছেন, প্রতি টন ৭৫ গ্রেডের রডে খরচ পড়ছে ৯০ হাজার টাকার ওপরে। ফলে দাম বাড়ার পরও তাদের প্রতি টন রডে ২ থেকে ৪ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।
মিল মালিকদের দাবি ভিত্তিহীন বলে মনে করেন মাঠ পর্যায়ের রড বিক্রেতারা। তারা বলছেন, বিগত সময়ে যেহেতু মালিকরা বেশি দামে রড বিক্রি করে আসছিলেন, বর্তমানে আগের তুলনায় দাম কমে আসায় তারা এটা মেনে নিতে পারছেন না বলেই লোকসানের কথা বলছেন।
বর্তমানে বাজারে বিএসআরএম ৯১ হাজার ৫০০ টাকা, জিপিএইচ ৮৮ হাজার এবং কেএসআরএম ও একেএস ৮৯ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
চট্টগ্রামের বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস (বিএসআরএম) গ্রুপের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিএমডি) তপন সেন গুপ্ত বাজারে সিন্ডিকেট কিংবা কারসাজির অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে বলেন, রডের দাম উৎপাদন খরচের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
বর্তমানে কাঁচামালের দাম বাড়ার পাশাপাশি ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া, ব্যাংক এক্সচেঞ্জ রেট ও উৎপাদন খরচ বাড়ার কারণে রডের দাম কিছুটা সমন্বয় হয়েছে। এটাকে আমরা বৃদ্ধি হিসেবে দেখছি না। কেননা, রডের দাম এক লাখের ওপরে ছিল, সেটা কমে অনেক নিচে নেমে গিয়েছিল। বর্তমানে চাহিদা বাড়ায় দাম কিছুটা বেড়েছে।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএমএ) সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে ছোট-বড় ইস্পাত কারখানার সংখ্যা দুই শতাধিক। এর মধ্যে বড় কারখানা ৫০টি। এতে বছরে প্রায় এক কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন রড উৎপাদনের সক্ষমতা আছে। দেশে বার্ষিক রডের ব্যবহার ৭৫ লাখ টন। এ খাতে ৭৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হলেও বছরে লেনদেনের পরিমাণ ৭০ হাজার কোটি টাকা।