অবশেষে পদত্যাগ করেছেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার মেয়ে ও ব্রিটেনের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনীতি বিষয়ক মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক। মঙ্গলবার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগপত্র পাঠান তিনি।
সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে লন্ডনে টিউলিপ সিদ্দিকের সম্পত্তি নিয়ে খবর প্রকাশের জেরে বিতর্ক তৈরি হয়। এছাড়া বাংলাদেশে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে অর্থ আত্মসাতের সঙ্গেও তার নাম আসায় টিউলিপ সিদ্দিকের ওপর বিভিন্ন দিক থেকে পদত্যাগের চাপ সৃষ্টি হয়।
পদত্যাগপত্রে টিউলিপ জানান, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ‘মান বিষয়ক উপদেষ্টা’ স্যার ল্যারি ম্যাগনাস তাকে ঘিরে বিতর্কের বিষয়ে তদন্ত করে জানিয়েছেন, তিনি কোনো নীতিমালা লঙ্ঘন করেননি। কিন্তু তার দায়িত্ব ঘিরে বিতর্কের জেরে পদত্যাগ করছেন তিনি।
টিউলিপ বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার সময় তিনি তার আর্থিক ও পারিবারিক বিষয়ে সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
এর আগে চলতি মাসের টিউলিপকে ঘিরে তৈরি হওয়া বিতর্কের জেরে তদন্তের জন্য নিজেকে স্যার ল্যারি ম্যাগনাসের কাছে সমর্পণ করেছিলেন তিনি।
এদিকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিট থেকে জানানো হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী এক চিঠির মাধ্যমে টিউলিপের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন।
চিঠিতে প্রধানমন্ত্রী স্টারমার লিখেন, ‘আমি আপনার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করছি। একইসঙ্গে আমি নিশ্চিত করছি, স্বাধীন ক্ষমতাসম্পন্ন উপদেষ্টা হিসেবে স্যার ল্যারি ম্যাগনাস আমাকে আশ্বস্ত করেছেন তিনি আপনার পক্ষ থেকে কোনো নীতির লঙ্ঘন দেখেননি এবং কোনো প্রকার আর্থিক অনিয়মের তথ্য নেই।’
টিউলিপ সিদ্দিককে পদত্যাগের জন্য দাবির মধ্যেই এর আগেও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তার প্রতি আস্থা থাকার কথা জানিয়েছেন।
এ নিয়ে গত জুলাই মাসে ব্রিটেনে লেবার পার্টির সরকার গঠনের পর দ্বিতীয় কোনো মন্ত্রী পদত্যাগ করলেন।
সাম্প্রতিক সময়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে লন্ডনে টিউলিপের উপহার পাওয়া ফ্ল্যাট নিয়ে প্রকাশিত খবরের জেরে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। খবরে অন্তত তিনটি ফ্ল্যাটের তথ্য জানানো হয়েছে, যা ব্রিটেনে উপহার পেয়েছেন তিনি।
খালা শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের একজন সমর্থক টিউলিপকে লন্ডনে ৭ লাখ পাউন্ডের একটি ফ্ল্যাট দিয়েছেন। আবার শেখ হাসিনার একজন উপদেষ্টা টিউলিপের বোনকে ৬ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ডের ফ্ল্যাট দিয়েছেন। উপহার পাওয়া এ সকল ফ্ল্যাট নিয়ে তথ্য গোপন করার কারণে চাপের মুখে পড়েন টিউলিপ।
এছাড়া বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ৫৯ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তদন্তের মুখে থাকা টিউলিপ সিদ্দিকের ওপর সম্পত্তি সংক্রান্ত এই বিতর্ক নতুন করে চাপ সৃষ্টি করছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক জানিয়েছে, তারা টিউলিপ সিদ্দিক, তার মা শেখ রেহানা, শেখ হাসিনা এবং আরও দুই আত্মীয়ের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে।
সম্পত্তির তথ্য গোপন এবং আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে নাম আসার পর ব্রিটেনে টিউলিপের পদত্যাগের দাবিতে আওয়াজ ওঠে।
গত শনিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক পোস্টে টিউলিপ সিদ্দিককে বরখাস্তের আহ্বান জানিয়েছেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বিরোধী কনজারভেটিভ পার্টির নেতা কেমি ব্যাডেনক।
ব্যাডেনক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘কিয়ার স্টারমারের জন্য এখনি সময় টিউলিপ সিদ্দিককে বরখাস্ত করা। তিনি তার ব্যক্তিগত বন্ধুকে দুর্নীতি দমনের জন্য মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন এবং তিনি (টিউলিপ) নিজেই দুর্নীতির জন্য অভিযুক্ত। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে।’
ওই পোস্টে তিনি আরও জানান, ব্রিটেনে অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে যখন কয়েক লাখ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত এবং সরকারের এই বিষয়ে মনোযোগী থাকার কথা, তখন টিউলিপ সিদ্দিক মনোযোগ নষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তার নীতি ও সততা নিয়ে সংকল্পবদ্ধ থাকার কথা জানিয়েছিলেন। টিউলিপ সিদ্দিককে নিয়ে তার আচরণ তার দাবির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
বিভিন্ন ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে টিউলিপের সরাসরি পদত্যাগের জন্য দাবি তোলা হয়।
রোববার দ্য টেলিগ্রাফে একটি প্রকাশিত এক নিবন্ধে সরাসরি বলা টিউলিপ সিদ্দিকের পদত্যাগের দাবি তোলা হয়। ‘নির্দোষ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত টিউলিপ সিদ্দিকের অবশ্যই সরে দাঁড়ানো উচিত’ (টিউলিপ সিদ্দিক মাস্ট স্ট্যান্ড ডাউন আনটিল শি ইজ ক্লিয়ার্ড) শিরোনামে ওই নিবন্ধে বলা হয়, দুর্নীতির বিষয়ে নজরদারির দায়িত্বে থাকা মন্ত্রীর বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা অগ্রহণযোগ্য।
নিবন্ধে বলা হয়, যদিও টিউলিপ সিদ্দিক অভিযোগের সঙ্গে নিজের কোনো প্রকার সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করেছেন। তবে যেহেতু বাংলাদেশে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকারের বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, টিউলিপের উচিত সরে দাঁড়ানো। এই পরিস্থিতিতে তার দুর্নীতি দমনের বিষয়ে দায়িত্ব পালন করা যৌক্তিক নয়।
সোমবার দ্য ফাইনান্সিয়াল টাইমসের ‘টিউলিপ সিদ্দিক কেন বরখাস্ত হননি?’ প্রতিবেদনে বলা হয়, গত নভেম্বরে যে কারণে ব্রিটিশ পরিবহনমন্ত্রী লুইস হেইজ পদত্যাগ করেন, তার থেকে গুরুতর অভিযোগ নিয়েও দায়িত্ব পালন করছেন টিউলিপ সিদ্দিক।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমার টিউলিপকে নিজের ‘ভালো বন্ধু ও সহকর্মী’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে ছিলেন। পার্লামেন্টের আসনের দিক থেকেও টিউলিপ স্টারমারের প্রতিবেশী। এছাড়া লন্ডনে পার্টির অভ্যন্তরে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখেন তিনি।
টিউলিপের খালা শেখ হাসিনার নেতৃত্বের আওয়ামী লীগকে অনেকেই ব্রিটেনের লেবার পার্টির সঙ্গে তুলনা করেন। লেবার কর্মকর্তাদের মতে, ‘সিদ্দিকের পরিবার বাংলাদেশের রাজনীতিতে কেনেডি পরিবারের মতোই।’ এ সকল কারণে তাকে পদচ্যুত করা হচ্ছে না বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়।