শেখ হাসিনার আমলে খেলাপি ঋণ লুকিয়ে রাখলেও এখন তা বেরিয়ে আসছে। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল প্রায় ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা। যার মধ্যে ৫২ হাজার কোটি টাকাই শীর্ষ ১০ গ্রুপের কাছে। এ গ্রুপে বেক্সিমকো ও এস আলমের নাম উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এতদিন এই তালিকায় এসব রাঘববোয়ালদের নাম ছিল না। ১০ গ্রুপ হলো- বেক্সিমকো, এস আলম, এনোনটেক্স, মাইশা, এফএমসি, ক্রিসেন্ট, রতনপুর, জাকিয়া কটন টেক্স, রিমেক্স ফুটওয়্যার এবং রাঙ্কা।
জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমার দেশকে বলেন, বড় ঋণ খেলাপিরা নিজেরাও গেছেন, সঙ্গে করে টাকাও নিয়ে গেছেন। এসব টাকা দেশে নেই। দেশে যেসব সম্পদ আছে সেগুলো ক্রোক করে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। আর বিদেশে যা চলে গেছে তার জন্য আলাদা টাস্কফোর্স করা হয়েছে। তবে বিদেশে পাচার করা টাকা ফেরানো কঠিন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেক্সিমকো গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২০ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকে ১৯ হাজার ৩৭২ কোটি এবং সোনালী ব্যাংকে এক হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। যদিও বেক্সিমকো গ্রুপের মোট খেলাপি ঋণ ২৩ হাজার ১২০ কোটি টাকা। বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমানের নামে-বেনামে ১৮৮ প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ রয়েছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ এস আলম গ্রুপের। তাদের ঋণের পরিমাণ ১১ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকে ৯ হাজার ২৭৩ কোটি এবং ইউনিয়ন ব্যাংকে ২ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা। এস আলম বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা ঋণ নামে বের করে নিয়েছেন।
ব্যাংকগুলোতে অডিট কার্যক্রম চলমান হওয়ায় এসব ঋণ এখনও খেলাপির খাতায় যুক্ত হয়নি। এস আলম গ্রুপের কর্ণধার চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম মাসুদ শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। এতদিন শীর্ষ ঋণ খেলাপির তালিকায় এ গ্রুপের নাম ছিল না।
ব্যাংক খাতে তৃতীয় সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ এনোনটেক্স গ্রুপের। তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা। এদের পুরো খেলাপি ঋণই জনতা ব্যাংকে। গ্রুপটির কর্ণধার ইউনুছ বাদল। জনতা ব্যাংক পুরো ঋণের অর্ধেক সুদ মওকুফ করেও ঋণ আদায় করতে পারেনি। ফলে পুনরায় ঋণগুলো খেলাপি হয়ে যায়।
শীর্ষ ১০-এ থাকা আরেক গ্রুপ মাইশা। তাদের খেলাপি ঋণ দুই হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা, পুরো খেলাপি ঋণটিই ন্যাশনাল ব্যাংকের। মাইশা গ্রুপের মালিক ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রয়াত সংসদ সদস্য আসলামুল হক।
ঢাকা-১৪ আসনের এমপি আসলামুল হক মারা যান ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল। রাজনীতির পাশাপাশি ব্যবসাও করতেন। ব্যবসা পরিচালনার জন্য ব্যাংক খাত থেকেই মূলত মূলধন জোগাড় করেন আসলামুল হক।
আরেক শীর্ষ খেলাপি এফএমসি গ্রুপ। তাদের খেলাপি ঋণ দুই হাজার ১৪৪ কোটি টাকা। গ্রুপের পুরো খেলাপি ঋণ ন্যাশনাল ব্যাংকের।
চামড়া খাতের আলোচিত ক্রিসেন্ট গ্রুপ খেলাপি ঋণের শীর্ষ ছয়ে আছে। তাদের খেলাপি ঋণ ২ হাজার ৩৯ কোটি টাকা, যার পুরো অংশই জনতা ব্যাংকের।
গ্রুপটির কর্ণধার আবদুল কাদের ও তার ভাই চলচ্চিত্র পরিচালক আবদুল আজিজ। আওয়ামী সরকারের মেয়াদে এ দুই গ্রুপের উত্থান হয় এবং ব্যাংক থেকে বিপুল ঋণ পায়।
চট্টগ্রামের ইস্পাত খাতের অন্যতম শিল্পপ্রতিষ্ঠান রতনপুর গ্রুপ। তাদের খেলাপি ঋণ ১ হাজার ২২৭ কোটি টাকা। পুরো ঋণই জনতা ব্যাংকের। এছাড়া জাকিয়া কটন টেক্সের অগ্রণী ব্যাংকে এক হাজার ২১০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে। রিমেক্স ফুটওয়্যারের জনতা ব্যাংকে এক হাজার ১৩৪ কোটি এবং রাঙ্কা গ্রুপের জনতা ব্যাংকে ১ হাজার ১৩২ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ২০১৯ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সুবিধা দেওয়ার কারণে অনেক বড় ঋণখেলাপি আড়ালে রয়ে গেছে। সেটি হলো পরিশোধযোগ্য ঋণের ২ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে ১০ বছরের জন্য খেলাপি ঋণের তালিকা থেকে নাম কাটানো যাবে। এই সুবিধা ব্যবহার করেই রাঘববোয়ালরা তালিকা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল।
শীর্ষ ১০ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০০ কোটির ওপরে : ব্যাংক খাতে ১০০ কোটি টাকার ওপরে শীর্ষ ১০ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৩০ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকেরই ৫২ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংকের ২১ হাজার ৫৭ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকের ১৫ হাজার ৬২৮ কোটি, এবি ব্যাংকের ৮ হাজার ১৬৫ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ৮ হাজার ১৬৫ কোটি, সোনালী ব্যাংকের ৭ হাজার ১৪৪ কোটি, ইউনিয়ন ব্যাংকের ৬ হাজার ৪৮৪ কোটি, ফার্স্ট সিকিউরিটির ৬ হাজার ২০৭ কোটি, আল-আরাফাহ ইসলামী ২ হাজার ৩০৪ কোটি এবং ট্রাস্ট ব্যাংকের ২ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা।
১০০ কোটির ওপরে খেলাপি ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি : ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১০০ কোটি টাকার ওপরে খেলাপি ১ লাখ ৪৭ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের অর্ধেক বা ৫১ দশমিক ৭০ শতাংশ। রাষ্ট্রায়ত্ত ১০০ কোটি ওপরে খেলাপি ৮৩ হাজার ৮৪৭ কোটি, বেসরকারি ব্যাংকে ৬২ হাজার ৩২৬ কোটি, বিদেশি ব্যাংকের ৩২৯ কোটি এবং বিশেষায়িত ব্যাংকের ৮৩২ কোটি টাকার রয়েছে।