উচ্চ মূল্যস্ফীতি, প্রয়োজনের তুলনায় খাদ্য আমদানির ঘাটতি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দেশের ২ কোটি ৩৬ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্যসংকটে ভুগছে। জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (এফএও) প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে সার্বিক অর্থনীতির স্থবিরতা ছিল। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বা প্রবৃদ্ধি অর্থনীতিতে খুবই সামান্য। বিনিয়োগ সে হারে নেই, কর্মসংস্থানও নেই। দুবছরের বেশি সময় উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে এমনিতেই আয় সংকুচিত হয়েছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও কমে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে খাদ্য নিরাপত্তায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সর্বশেষ ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি বলছে, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় দুই কোটি ৩৬ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা এবং তার বেশি উচ্চস্তরের মুখোমুখি হয়েছে।
আইপিসির এর আগের প্রতিবেদনে এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এক কোটি ৬৫ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় পড়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ আইপিসির পূর্বাভাসের চেয়েও বেশিসংখ্যক মানুষ তীব্র খাদ্য সংকটে পড়েছে।
খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতির জন্য মূলত বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় রেমালের নেতিবাচক প্রভাবকে দায়ী করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এ সংকটের কারণে প্রায় এক কোটি ৯০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এ সময় ফসল, গবাদিপশু, খাদ্য মজুত এবং কৃষি অবকাঠামোর মারাত্মক ক্ষতি হয়।
খাদ্য নিরাপত্তাহীন মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ কী হতে পারে- এর ব্যাখ্যায় বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী আমার দেশকে বলেন, এ সংকটের বড় কারণ হচ্ছে এ সময়ে সার্বিক অর্থনীতির স্থবিরতা ছিল। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বা প্রবৃদ্ধি অর্থনীতিতে খুবই সামান্য, বিনিয়োগ সে হারে নেই, কর্মসংস্থানও নেই। উৎপাদন না বাড়লে কর্মসংস্থান হবে না। বেকারত্ব বেড়েছে এ সময়ে। সব মিলিয়ে জনগণের দিক থেকে চাহিদা ছিল খাদ্য কেনার যে আর্থিক সংগতি দরকার, সেটি অনেক কমে গেছে।
তিনি আরও বলেন, এর প্রভাব পড়েছে নিম্ন আয় ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেশের অর্থনীতিতে দুবছরের বেশি সময় বিরাজমান। খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখনও ১৩ শতাংশের কাছাকাছি। এমনিতেই আয় সংকুচিত হয়েছে, আবার উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে তাদের ক্রয়ক্ষমতাও কমেছে।
এ মূল্যস্ফীতি দীর্ঘদিন বিদ্যমান থাকায় মানুষকে ঋণ করতে হচ্ছে, তাদের তো প্রচুর ব্যাংক ব্যালেন্সও নেই। ফলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মত দেন মুস্তফা কে মুজেরী।
দেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ক্রয়ক্ষমতা আরও কমতে পারে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে এফএওর প্রতিবেদনটিতে। এতে বলা হয়েছে, গত দুবছর দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন আশানুরূপ হলেও সংকট কাটছে না সাধারণ ভোক্তার। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি শস্যের উৎপাদন সত্ত্বেও ক্রমাগত উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতির কারণে খাদ্যের প্রাপ্যতা নিয়ে উদ্বেগ রয়ে গেছে। যার ফলে দুর্বল পরিবারের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে।
২০২২ সালের আগস্ট থেকে খাদ্য মূল্যস্ফীতি উচ্চস্তরে রয়ে গেছে এবং ২০২৪ সালের অক্টোবরে এটি ১২ দশমিক ৭ শতাংশ প্রকাশ করা হয়েছিল। এ উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণ ছিল উৎপাদন ও পরিবহনের উচ্চ ব্যয়, খাদ্যশস্য আমদানি (বিশেষ করে প্রধান পণ্য গম) হ্রাস এবং টাকার উল্লেখযোগ্য অবমূল্যায়ন। টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আমদানি ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে।
খাদ্য আমদানি চাহিদার তুলনায় কম
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শস্য আমদানির বেশিরভাগই গম। এটি দেশের ভোগ্য চাহিদার ৮০ শতাংশ পূরণ করে। তবে গমের পাশাপাশি অল্প পরিমাণে চাল ও ভুট্টাও আমদানি করা হয়। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট খাদ্যশস্য আমদানির প্রয়োজনীয়তা গড়ে ৮৩ লাখ টনেরও কম হওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
তবে জিআইইডব্লিএসের বৈশ্বিক তথ্য এবং খাদ্য ও কৃষি সম্পর্কিত প্রাথমিক সতর্কতা ব্যবস্থা অনুসারে ২০২৫ সালে বাংলাদেশে চাল আমদানি ৪ লাখ ৫০ হাজার টন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। গমের আমদানি প্রায় গড়ে ৬১ লাখ টনেরও বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গবাদিপশু ও মৎস্যশিল্পে খাদ্যের স্থিতিশীল চাহিদার কারণে ভুট্টার আমদানি গড়ে ২১ লাখ টনেরও বেশি হওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
আগের দুই অর্থবছর (২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪) খাদ্যশস্য আমদানি গড় স্তরের অনেক নিচে ছিল। এর মূল কারণ ছিল ২০২২ সালের মে থেকে ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া। পাশাপাশি টাকার উল্লেখযোগ্য অবমূল্যায়নের কারণে দেশের আমদানি ক্ষমতা সীমাবদ্ধ ছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ও জাতীয় মুদ্রা এখনও বেশ দুর্বল থাকায় চলতি অর্থবছরেও আমদানির প্রয়োজনীয়তা সম্পূর্ণরূপে পূরণ করার জন্য বাংলাদেশ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে বলেও সতর্ক করা হয় প্রতিবেদনটিতে।