বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ উদ্বেগজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে রাজস্ব আয়ের ঘাটতি মেটাতে সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে অধিক হারে ঋণ নিচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে আগের বছরের তুলনায় সরকারের ঋণ বেড়েছে প্রায় ৭১ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে নতুন করে বিনিয়োগে যাচ্ছে না। ফলে বেসরকারি খাতের ঋণও প্রয়োজন হচ্ছে না। আবার ব্যাংকগুলো ঝুঁকি বিবেচনায়ও নতুন করে ঋণ দিচ্ছে না। সরকারের ঋণের সুদহার ঊর্ধ্বমুখী এবং নিরাপদ হওয়ায় ব্যাংকগুলো সেখানে বিনিয়োগ করছে। এছাড়া রাজস্ব আয় না থাকায় সরকারও বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ বাড়িয়েছে। ফলে এ খাত থেকে সরকারের ঋণ বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়েছে ৬৫ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩৮ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ঋণ বেড়েছে ২৭ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা বা ৭০ দশমিক ৬২ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমার দেশকে বলেন, রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি নেই। আবার সরকারের চাহিদাও কমছে না। তাই সরকারের চাহিদা মেটাতে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। আর ব্যাংকগুলো উচ্চ সুদ ও নিরাপদ বিনিয়োগের কারণে সরকারকে ঋণ দিচ্ছে।
বেসরকারি খাতে ঋণ না যাওয়ায় আগামীর অর্থনীতির পরিস্থিতি কেমন হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেসরকারি খাতের স্থবিরতা ভিন্ন কারণে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সঙ্গে মূল্যস্ফীতি উচ্চ পর্যায় রয়েছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। আগামীতে অর্থনীতির নীতিগুলো কী হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। যদিও ব্যাংক, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে বেশকিছু উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। তবে সংস্কারের এখনও কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। এসবই বেসরকারি খাতের স্থবিরতার বড় কারণ।
তিনি আরও বলেন, ব্যবসায়ীরা সুদহার বেড়ে যাওয়ার কারণে যে স্থবিরতার কথা বলছে তা ঠিক নয়। এটা মৌলিক কারণ নয় বরং অজুহাত। সুদের হার কমালে সব ঠিক হয়ে যাবে না। কারণ সুদের হার যখন ৯ শতাংশে ছিল সে সময় বিনিয়োগে কোনো রকম প্রাণ দেখা যায়নি।
এদিকে প্রতিবেদনে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আগের ঋণ পরিশোধ করতেও দেখা গেছে। তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৪৪ হাজার ৪৭৯ কোটি টাকার আগের ঋণ পরিশোধ করেছে। গত অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৪৩ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা। ফলে এ অর্থবছর এখন পর্যন্ত ব্যাংক খাত থেকে সরকারের নিট ঋণ দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা। যদিও গত অর্থবছরের একই সময় নিট ঋণ ৫ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা ঋণাত্মক ছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারকে ডেভলমেন্ট বা টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেওয়া বন্ধ করেছে। আবার পরিশোধ করার ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ স্থিতি কমছে। এটা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভালো ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারকে সরাসরি ঋণ দিলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়।
এদিকে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নানা রকম পদক্ষেপ নিচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে টাকার সরবরাহ কমিয়ে আনতে কয়েক দফা নীতি সুদহার বা পলিসি রেট বাড়িয়েছে। তবুও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বরে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি আরও কঠোর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, কঠোর মুদ্রানীতির ফলে ঋণ নেওয়ার খরচ বাড়বে, যা বিনিয়োগকে প্রভাবিত করবে এবং শেষ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি কমে আসবে।
তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার প্রবৃদ্ধির চেয়ে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার এবং মূল্যস্ফীতিকে স্থিতিশীল করতেই বেশি মনোযোগ দিচ্ছে বলে জানান তিনি।
বর্ধিত সুদের হারের কারণে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ইতোমধ্যে একক সংখ্যায় নেমে এসেছে। এ সুদহার বর্তমানে ১৩ শতাংশের কিছু উপরে রয়েছে।