শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৪৮ পূর্বাহ্ন

ছাত্রদলের ১১ গুরুত্বপূর্ণ কমিটিতে ত্যাগী নেতাদের বাদ দেওয়ায় বিক্ষোভ

  • সময়: বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৮.৪৪ এএম
  • ৫ জন

রাজধানী ঢাকায় ছাত্রদলের গুরুত্বপূর্ণ ১১ ইউনিটের কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে নানা আলোচনা-সমালোচনা দেখা দিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে নবগঠিত ইউনিট কমিটিতে ত্যাগী নেতাদের অবমূল্যায়ন করে বিতর্কিতদের রাখা হয়েছে। পদ পাওয়ার তালিকায় রয়েছেন বিগত সরকারবিরোধী আন্দোলনে নিষ্ক্রিয়, চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত, ধর্ষণ মামলার আসামি ও অছাত্ররা। বাদ পড়েছেন আওয়ামী সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখা, নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার, মামলা-হামলায় জর্জরিত ও গুমের শিকার হওয়া নেতাকর্মীরা। এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ছাত্রনেতারা। গত ২ দিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ও স্পটে বিক্ষোভ করেছেন পদবঞ্চিতরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও নিন্দার ঝড় উঠেছে। ছাত্রদলের দায়িত্বশীল নেতাদের কুশপুত্তলিকা দাহ করার ঘটনাও ঘটেছে।

খোদ বিএনপির অনেক কেন্দ্রীয় নেতা বলেছেন, ত্যাগীদের বাদ দেওয়ার আগে কেন্দ্র বা অন্য সংগঠনে পদ দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করা উচিত ছিল। এখন ত্যাগী ও পরীক্ষিতদের কোথায় জায়গা দেবে তাও পরিষ্কার করা উচিত। না হলে আগামীতে রাজনৈতিক সংকট দেখা দিলেও অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজপথে আর থাকবেন না। এ ধরনের ঘটনা তৃণমূলেও খারাপ বার্তা যাচ্ছে।

মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছির স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে ১১টি ইউনিটের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে, ঢাকা মহানগর উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, তেজগাঁও কলেজ, সরকারি বাংলা কলেজ, সরকারি কবি নজরুল কলেজ, ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট। সবচেয়ে বেশি বিতর্ক উঠেছে তেজগাঁও কলেজ, বাংলা কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, তিতুমীর কলেজ, ঢাকা মহানগর চার শাখা ছাত্রদলের কমিটি নিয়ে।

নেতাকর্মীরা জানান, ঘোষিত এ কমিটিতে গত বছরের ২৮ অক্টোবর বিএনপির একদফা আন্দোলন কিংবা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় অনেক নেতাদের বাদ দেওয়া হয়েছে। যারা জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন তাদের কমিটির কোথাও রাখা হয়নি। আবার গুরুত্বপূর্ণ মহানগর কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে মহানগর বিএনপির নেতাদের কোনো পরামর্শও নেওয়া হয়নি। চিরাচরিত রেওয়াজ ভেঙে এভাবে কমিটি গঠন করায় ক্ষুব্ধ ও বিব্রত দুই মহানগর বিএনপির নেতারা। কিভাবে ও কোন প্রক্রিয়ায় এরকম কমিটি গঠন করা হয়েছে তাও কেউ বলতে পারেন না বলে জানান নেতাকর্মীরা।

তারা আরও জানান, ৫ আগস্টের পর চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত, ধর্ষণ মামলার আসামি, অছাত্র এবং বিতর্কিত নেতাদের কমিটিতে পদায়ন করা হয়েছে। পক্ষান্তরে বিগত দিনে রাজপথে সক্রিয় থাকা নেতাকর্মী, ২৮ অক্টোবরের পর থেকে আন্দোলন এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে জোরালো ভ‚মিকা পালনকারী, হামলা-মামলায় জর্জরিত এবং স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের আমলে গুমের শিকার নেতাদের বাদ দেওয়া হয়েছে।

যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, ‘আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই যারা বিগত আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন তাদের দিয়ে কমিটি গঠন করেছি। নতুনদের কমিটিতে মূল্যায়নের চেষ্টা করেছি। এবারের কমিটি ৪৫ দিনের জন্য দেওয়া হয়েছে। এরপর প্রতিটি ইউনিটে সম্মেলনে ভোটের মাধ্যমে চূড়ান্ত নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে।’

ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে নতুন কমিটি দেওয়া হয়েছে সেগুলো মাত্র ৪৫ দিনের জন্য সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি। অর্থাৎ আগামী ৪৫ দিনের মধ্যে তারা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে সম্মেলন আয়োজন করে বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে নেতৃত্ব বাছাইয়ের ব্যবস্থা করে বর্তমান শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব হস্তান্তর করবে। এই কমিটির দায়িত্ব মূলত ৪৫ দিনের মধ্যে বর্তমান শিক্ষার্থীদের হাতে নেতৃত্ব হস্তান্তরের ব্যবস্থা করা।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতাকর্মীরা জানান, দীর্ঘদিন পরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটি হয়েছে। নতুন কমিটিতে আহ্বায়ক হলেন- মেহেদী হাসান হিমেল, সদস্য সচিব সামসুল আরেফিন। এই কমিটিতে বিগত দিনে যারা আন্দোলন-সংগ্রামে জীবন বাজি রেখে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাজপথে থেকেছেন তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে। কমিটি গঠনের এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের এক শীর্ষ নেতার প্রভাব রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া কমিটির অন্যান্য ২৮ যুগ্ম আহ্বায়ক ও সদস্যের মধ্যে বেশিরভাগই অপরিচিত এবং কম সক্রিয় বলে জানান নেতাকর্মীরা।

তেজগাঁও কলেজ শাখার ৩২ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে আহ্বায়ক পদ পেয়েছেন তরুণ মোর্শেদ, সদস্য সচিব সেলিম হোসেন। তরুণ মোর্শেদ ২০১৩ সালের পর থেকে আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন না বলে জানা গেছে। সেলিম হোসেনও আন্দোলনের মাঠে নিয়মিত ছিলেন না। এদিকে তেজগাঁও ছাত্রদলের সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. বেলাল হোসেন খান গুমসহ ১৮ মাস কারাগারে ছিলেন, আন্দোলন করতে গিয়ে মিথ্যা হত্যা মামলাসহ একাধিক মামলার আসামি। অথচ তাকে কোনো পদেই রাখা হয়নি। ছাত্রদল নেতা আশিকুর রহমানকে গত বছরের ২৮ অক্টোবরের পর অবরোধের মিছিল থেকে গ্রেফতার করা হলেও কমিটিতে তার স্থান হয়নি। এ ছাড়া সক্রিয় থাকা সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমেদ রবিন, নাঈমুল ইসলাম নাজিম, মামুন মালতিয়া, নাজমুল হুদা রাকিব, মেশকাত হোসেন, নাহিদুল ইসলাম ব্যাপারী, আনোয়ার হোসেন রানা কাউকে রাখা হয়নি। তেজগাঁও কলেজ কমিটি বাতিলের দাবিতে ধারাবাহিক বিক্ষোভ মিছিল করছেন হামলা-মামলায় নির্যাতিত নেতাকর্মীরা।

সরকারি বাংলা কলেজের আহ্বায়ক মো. মোখলেসুর রহমান ও সদস্য সচিব ফয়সাল রেজার বিরুদ্ধেও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। আহ্বায়ক সরকারি বাংলা কলেজের ছাত্র নন, তিনি বাংলা কলেজের প্রাইভেট ছাত্র বলে অভিযোগ রয়েছে। সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক হাফিজুর রহমান হাফিজ বাংলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করলেও এখন অনার্সের নিয়মিত ছাত্র নন। আর ফয়সাল রেজা একাধিক নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ মামলার আসামি, এমনটা জানান ছাত্রনেতারা। তার বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী এক নারী ছাত্রদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ কেন্দ্রীয় দপ্তরে অভিযোগ দিলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কলেজের সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক সরদার মোহাম্মদ মিলন আন্দোলনের সর্বাগ্রে থাকলেও তাকে কমিটির কোথাও রাখা হয়নি।

যদিও ফয়সাল দাবি করেন, তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ভিত্তিহীন। যে কোনো ব্যক্তি অভিযোগ করতে পারেন, কিন্তু প্রমাণ করার মতো পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ নেই। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কেউ কেউ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে।

ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদলের সভাপতি প্রার্থী ছিলেন মো. মনিরুজ্জামান। সদ্য ঘোষিত কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের চেয়েও যোগ্য নেতা তিনি। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গুরুতর আহত মো. মনিরুজ্জামানকে পদবঞ্চিত করা হয়েছে। তার মাথায় এখনো ২৩টি সেলাই রয়েছে। আর সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান মিম আন্দোলনে তেমন একটা সক্রিয় ছিলেন না বলে দাবি করেছেন কেউ কেউ। অপরদিকে মহানগর দক্ষিণের সাবেক সদস্য সচিব নিয়াজ মাহমুদ লিয়ন আন্দোলনে সক্রিয় থাকলেও কমিটিতে তার ঠাঁই হয়নি। এ ছাড়াও সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুল ইসলাম তপু, রুবেল আহমেদ সক্রিয় থাকলেও পদ পাননি। অথচ আন্দোলনে মহানগর পূর্ব শাখা ছাত্রদলের সিনিয়র সভাপতি আবদুল্লাহ জামান চৌধুরী আদিত্য এবার সভাপতি পদপ্রত্যাশী ছিলেন। তিনি বর্তমান সভাপতি সোহাগ ভূঁইয়ার চেয়েও যোগ্য নেতা বলে দাবি করেছেন অনেকে।

মহানগর দক্ষিণ ছাত্রদলের নতুন কমিটিতে সিনিয়র সহসভাপতি মাহমুদ উল্লাহ মাহমুদ বিবাহিত বলে অভিযোগ রয়েছে। অনেকেই দাবি করেছেন, তার ভাই নিষিদ্ধ ঘোষিত কামরাঙ্গীরচর থানা ছাত্রলীগের নেতা। সহসভাপতি রুবেল আহমেদ রানার একাডেমিক কোনো সার্টিফিকেট নেই। সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম রফিক উন্মুক্ত থেকে ২০১৮ সালে এসএসসি পাশ করেছেন।

ইমাম হোসেনকে আহ্বায়ক ও সেলিম রেজাকে সদস্য সচিব করে তিতুমীর কলেজ শাখা ছাত্রদলের ৩৯ সদস্যের কমিটি দেওয়া হয়েছে। ছাত্রনেতাদের অভিযোগ সেলিম রেজা বিবাহিত। অথচ বিগত আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ও পুলিশের হামলার শিকার যুগ্ম আহ্বায়ক মো. রিমু হোসেনের নাম অনেক নিচে রাখা হয়েছে। ২৮ অক্টোবরের আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয় এই সাংগঠনিক ইউনিট। সেখানে যেসব নেতাকর্মীকে গ্রেফতারের পর দিনের পর দিন নিখোঁজ রাখা হয়, অকথ্য নির্যাতনের পর কারাগারে পাঠানো হয় এমন নেতাদের স্থান হয়নি।

ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক হলেন পিয়াল হাসান, সদস্য সচিব মো. মিল্লাত হোসেন। পিয়াল হাসান আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সায়েন্সল্যাব মোড়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা বোরহান উদ্দিন ইশরাক ও তানভীর আহমদ মাদবরকে করা হয়েছে যুগ্ম আহ্বায়ক। বংশালে পুলিশের পা ভেঙে দিলেও মো. সাজ্জাদ হোসেন জেমিনকে সদস্য করা হয়েছে।

এরকমভাবে প্রতিটি ইউনিট কমিটিতে কিছু বিতর্কিত আর অযোগ্যদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। নিজ নিজ বলয়ের নেতাদের প্রাধান্য দিতে গিয়ে বাদ দেওয়া হয়েছে ত্যাগী, নির্যাতিত আর রাজপথের কর্মীদের।

নতুন কমিটিকে স্বাগত জানিয়ে রাজধানীর নয়াপল্টনে আনন্দ মিছিল করেছেন ছাত্রদলের নেতারা।

আপনার সামাজিক মাধ্যমে খবরগুলো শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved © 2024
Developed BY www.budnews24.com