পণ্য আমদানির ট্যারিফ হ্রাস, ঋণের সুদ বাড়ানোসহ কয়েকটি উদ্যোগ নেওয়ার পরও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুফল মিলছে না। অর্থনৈতিক বৈরী পরিস্থিতির মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ ধরে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে বর্তমানে ১১ শতাংশের ঘরে বিরাজ করছে মূল্যস্ফীতির হার। নিয়ন্ত্রণে আনতে ইতোমধ্যে সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ সাধন, কম গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প বাদ দেওয়া এবং বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। কিন্তু এরপরও বাগে আনতে না পেরে সরকারের ঘোষিত মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৬.৫ থেকে ৮ শতাংশে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থ বিভাগ।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই বৈঠকে ধারণা করা হয়েছে, সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ সাধন, পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখায় জুন নাগাদ ‘পয়েন্ট টু পয়েন্ট’ ভিত্তিতে গড় মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে নেমে আসবে। এদিকে সরকারের নথিপত্রে আগামী তিন অর্থবছরের (২০২৫-২৬, ২০২৬-২৭ ও ২০২৭-২৮) মূল্যস্ফীতির গড় লক্ষ্যমাত্রা ৫ দশমিক ৬ শতাংশের ওপরে অতিক্রম করবে না-এমন প্রাক্কলন করা হয়েছে। তবে বিশ্লেষকদের অভিমত-নথিপত্রে প্রাক্কলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এ পূর্বাভাসের সঙ্গে একমত হতে পারেননি অর্থনীতিবিদরা। কারণ, বর্তমান খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, নভেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১৩ দশমিক ৮০, আর শহরের ১৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ দাঁড়িয়েছে। এটি গত সাড়ে ১৩ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হার। জুলাইয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছিল। নভেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি সার্বিক মূল্যস্ফীতিও বেড়ে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে উঠেছে। অর্থাৎ গত বছরের নভেম্বরে ১০০ টাকায় যে পণ্য ও সেবা কেনা গেছে, চলতি বছরের নভেম্বরে একই পরিমাণ পণ্য ও সেবা কিনতে ভোক্তাকে ১১১ টাকা ৩৮ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।
অর্থনীতিবিদদের শঙ্কা-ডলারের মূল্য ফের বাড়তে শুরু করেছে, যা আগামী দিনে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের জুনের মধ্যে সরকারের সংশোধিত মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৭ শতাংশে নামিয়ে আনা অত্যন্ত কঠিন হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনভেস্টরস কনফারেন্সে বলেছেন, মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে আরও ১০ থেকে ১২ মাস লাগবে। জুনের মধ্যে ৭ শতাংশ আর আগামী অর্থবছরে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রত্যাশা করছি। তিনি বলেন, বাজারে সরবরাহব্যবস্থার ঘাটতির কারণে দ্রুত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না।
চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। বিশ্ববাজারে পণ্য ও জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে অনেক দেশে মূল্যস্ফীতি ঘটে। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক ও মূল্য হ্রাসের কারণে অনেক দেশে পর্যায়ক্রমে নেমে আসে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি উলটো আরও বাড়তে থাকে। সেটি মোকাবিলা করতে গিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী ভর্তুকি দেওয়ার সঙ্গে স্বল্পমূল্যে পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। এক কোটি পরিবারকে স্বল্পমূল্যে টিসিবির পণ্য দেওয়া হচ্ছে। নীতি সুদহার ১৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে।
এদিকে নিম্ন-আয়ের মানুষকে স্বস্তি দিতে এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাল, আলু, ডিম, পেঁয়াজ, তেল, চিনি, খেজুর আমদানিতে শুল্ক ছাড় দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ ছাড়ের ফলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দুই হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারাবে। অথচ শুল্কছাড়ের কোনো প্রভাব নেই বাজারে। কমা তো দূরের কথা, উলটো এসব পণ্যের দাম বাড়ছে।
জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ যুগান্তরকে জানান, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পণ্যের শুল্কহার কমিয়ে কোনো কাজে আসছে না। আওয়ামী লীগ সরকার সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নেওয়ার পরও মূল্যস্ফীতি কমেনি। একই সময়ে বিশ্বের অনেক দেশে পণ্যের মূল্য কমেছে। এর প্রভাব আমাদের দেশে পড়ার কথা। কিন্তু দেশে কোনো পণ্যের মূল্য কমেনি। অর্থনীতিতে চাহিদা ও সরবরাহের ওপর নির্ভর করে বাজার পরিস্থিতি। কিন্তু বাস্তবে সেটি ঘটছে না। এর অর্থ-বাজারে সিন্ডিকেটের উপস্থিতি রয়েছে। এছাড়া রয়েছে বাজার ব্যবস্থাপনাজনিত সমস্যা। অর্থ বিভাগ সংশোধিত মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৮ শতাংশ নির্ধারণ করেছে ভালো, তবে বাস্তবে তা অর্জন করা অনেক কঠিন হবে।
সরকারের ‘আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল’ বৈঠকে আগামী তিন অর্থবছরের মূল্যস্ফীতির প্রাক্কলিত লক্ষ্যমাত্রার অনুমোদন দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। সেখানে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। এটি আগামী বাজেটে ঘোষণা দেওয়া হবে। এর বাইরে ২০২৬-২৭ অর্থবছরের জন্য ৫ দশমিক ৫০ এবং ২০২৭-২৮ অর্থবছরের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ে অর্থ বিভাগের এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়, কোভিড-১৯ অতিমারির পরবর্তী সময়ে চাহিদার উল্লম্ফন এবং বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থায় অস্থিরতার কারণে বিশ্বে মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকলে বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়ে। ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে গড় মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ১১ শতাংশ অতিক্রম করে। অক্টোবরে এটি ১০ দশমিক ৮৭ এবং নভেম্বরে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে ওঠে।
সেখানে আরও বলা হয়, এরই মধ্যে বিশ্বের অনেক দেশের মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনা হয়। ২০২২ সালে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৬ শতাংশ, যা ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। একইভাবে ২০২২ সালে উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৩ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছরে আশা করা হচ্ছে ২ শতাংশে নেমে আসবে। একইভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মূল্যস্ফীতি ২০২২ সালে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ হলেও সেটি চলতি অর্থবছরে ২ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে আসবে বলে আভাস দিয়েছে আইএমএফ। উদীয়মান ও উন্নয়নশীল এশীয় দেশগুলোর মূলস্ফীতি ২০২২ সালে ৩ দশমিক ৯ বিরাজ করলেও চলতি অর্থবছরে ২ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে আসবে। একইভাবে বাংলাদেশের গড় মূল্যস্ফীতি ‘পয়েন্ট টু পয়েন্ট’ ভিত্তিতে ২০২২ সালে ছিল ৬ দশমিক ২, সেটি পর্যায়ক্রমে বেড়ে নভেম্বরে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে।