মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৫ পূর্বাহ্ন

মুজিবুলে ভর করে কোটিপতি শ্বশুরবাড়ির লোকজন!

  • সময়: রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১০.৩১ এএম
  • ২৯ জন

সাবেক রেলমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক দায়িত্বে থাকার সময়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন। স্ত্রী হনুফাকে খুশি করতে শ্বশুরবাড়ির লোকদের কোটিপতি বানিয়েছেন সাবেক রেলমন্ত্রী। স্ত্রী হনুফা ছিল তার দুর্নীতির ক্যাশিয়ার। সম্প্রতি সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুলের বিছানায় টাকার বান্ডিলের ছড়াছড়ি এমন ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে নতুন করে আলোচনায় আসেন তিনি।

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের সাবেক সংসদ সদস্য ও রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হক অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে গড়ে তোলা সম্পদের পাহাড়ের নমুনা হিসেবে শুক্রবার বিকাল থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুজিবুল হকের বিছানায় ছড়িয়ে থাকা টাকার বান্ডিলের একটি ছবি ভাইরাল হয়েছে। তবে ভাইরাল ওই ছবিটি কবেকার সে সময় সম্পর্কে জানা যায়নি।

ছবিতে দেখা যায়, বিছানায় বসে আছে মুজিবুল হকের তিন শিশু সন্তান। সন্তানদের সামনে ৫০০ এবং ১০০০ টাকা নোটের কয়েকটি বান্ডিল পড়ে আছে।

মুজিবুল হক তার এক সন্তানকে কোলে নিচ্ছিলেন। এক শিশু একটি শপিং ব্যাগে থাকা টাকার বান্ডিল নিয়ে খেলা করছে। মুজিবুল হকের স্ত্রী হনুফা আক্তার দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য দেখছেন।

 

ধারণা করা হচ্ছে, সাবেক সংসদ সদস্য মুজিবুল হকের কোনো এক সন্তানের জন্মদিনের ছবি এটি।

সন্তানের জন্মদিন উৎসবকে আরো আনন্দময় করতে কয়েক বান্ডিল টাকা ছড়িয়ে দেন বিছানায়। এ সময় মুজিবুল হকের খুব কাছের কেউ সেই ছবিটি তুলেছেন। গত ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর গা ঢাকা দেন চৌদ্দগ্রাম আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী মুজিবুল হক।

 

সূত্র জানায়, নির্বাচনী হলফনামায় নগদ ২০ হাজার টাকাসহ স্থায়ী-অস্থায়ী সম্পদের পরিমাণ প্রায় এককোটি টাকার হিসেব দেখালেও এখন তার শত শত কোটি টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। রেলমন্ত্রী হওয়ার পরই তিনি অবৈধ পন্থায় এসব সম্পদ গড়ে তুলেছেন।

তার এই অবৈধ টাকায় শ্বশুরবাড়ির লোকজন আলিশান ফ্ল্যাট-বাড়ি, জমির মালিক হয়েছেন এবং বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন।

 

মুজিবুলের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, নিয়োগ বাণিজ্য, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কমিশন বাণিজ্য, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলিসহ বিদেশে ব্যবসা, নেতাকর্মীদের কাছ থেকে ব্যবসার মুনাফা, টেন্ডারের কমিশন, চাঁদাবাজির ভাগসহ নানা উপায়ে শত শত কোটি টাকা অর্জন করেছেন মুজিবুল হক। এগুলো দেখভাল করতেন রেলমন্ত্রীর স্ত্রী হনুফা বেগম।

মুজিবুল হকের শাশুড়ির নামেও কিনে দিয়েছেন ফ্ল্যাট- বাড়ি। তার স্ত্রীর অন্য তিন বোন আগে সাধারণ জীবনযাপন করলেও মুজিবুল হকের সঙ্গে বোনের বিয়ের পর তাদেরও কপাল যেন খুলে যায়। তারা এখন আলিশান বাসায় থাকেন এবং বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন। শ্বশুরের পরিবারের সকলকে বিলাসবহুল চলাচলের অর্থের জোগানদাতা সাবেক এই মন্ত্রী। আর এসব কাজে সহায়তা করেছেন সাবেক এই মন্ত্রীর স্ত্রী হনুফা বেগম, তার ভাগ্নে এবং শ্যালক নাসির।

সূত্র জানায়, রেলের বেশির ভাগ নিয়োগ বাণিজ্যের লেনদেনের সঙ্গে জড়িত মুজিবুল হকের স্ত্রী হনুফা বেগম ও তার নিকটাত্মীয়রা। মিষ্টির প্যাকেটে করে, মাছের ঝুড়িতে করে লাখ লাখ টাকা নিকটাত্মীয়রা হনুফা বেগমের কাছে হস্তান্তর করতেন। মুজিবুল হক অবৈধ সম্পত্তির বেশির ভাগ শ্বশুরবাড়ির লোকজনের নামে গড়ে তুলেছেন যাতে কেউ তাকে ধরতে না পারে। তার এই কাজে সহযোগিতা করেছেন মুজিবুলের ফুফাতো ভাই লুৎফর রহমান খোকন। খোকন একটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে একটি ফ্ল্যাট ক্রয়ের জন্য নগদ ৭৬ লাখ টাকা খোকনকে দেন মুজিবুল হক। যদিও এখন পর্যন্ত খোকনকে ওই ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেননি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরই রেলমন্ত্রী হন মো. মুজিবুল হক। মন্ত্রী হওয়ার পরই ধানমণ্ডির ২৮ নম্বরে  (রোড-এ) বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ক্রয় করেন তিনি। যার বর্তমান বাজারমূল্য আনুমানিক ১২ কোটি টাকা। এটি তার শাশুড়ির নামে ক্রয় করা হয়। রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় জমি ক্রয় করে ১০ তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে ৪ তলা বাড়ি নির্মাণ করেন। যার ঠিকাদার মো. লুৎফর রহমান খোকন। কুমিল্লার ঝাউতলায় ২৯৫ নম্বর বাড়িতে ২/৩টি ফ্ল্যাট, কালীগঞ্জ এলাকায় বাণিজ্যিক জায়গাতে কয়েকটি দোকান ক্রয় করেন।

রাজধানীর কমলাপুরে বহুতল ভবন প্রথমে স্ত্রী ও ভাগ্নে বিপ্লবের নামে ক্রয় করা হয়। পরে শাশুড়ির নামে স্থানান্তর করা হয়। এ ছাড়াও কুমিল্লার নিমসার কাবিলাতে স্ত্রীর দ্বিতীয় বোন শিরীন আক্তারকে বিলাসবহুল ভবন নির্মাণ করে দিয়েছেন সাবেক এই মন্ত্রী। চান্দিনার মিরাখলা শ্বশুরবাড়ির অন্যসব বসতি তুলে দিয়ে রাজকীয় বাড়ি নির্মাণ করে দিয়েছেন তিনি। একইভাবে চান্দিনার মিরাখলাতে মন্ত্রী তার স্ত্রীর তৃতীয় বোনকে বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করে দিয়েছেন। তারা এর আগে খুব সাদামাটা জীবনযাপন করতেন।

সূত্র জানায়, চান্দিনার বিলাসবহুল কমপ্লেক্স এলাকায় মন্ত্রী তার স্ত্রীর চতুর্থ বোনকে জমি ক্রয় করে বাড়ি নির্মাণ করে দিয়েছেন। রাজধানীর ৬০ ফিট আগারগাঁওয়ে বাড়ি ক্রয় করেন মন্ত্রী। যেখানে মন্ত্রীর স্ত্রীর বড় বোন বসবাস করছেন। বগুড়াতে বিভিন্ন কমার্শিয়াল ভবনে দোকান ক্রয় করেছেন মন্ত্রী। যার পরিচালনা করেন মন্ত্রীর স্ত্রীর ভাগ্নে বিপ্লব। বিভিন্ন নেতাকর্মীকে নগদ টাকা দিয়ে ব্যবসার সুযোগ করেও দিয়েছেন মন্ত্রী। যেখান থেকে প্রতি মাসে মুনাফা নিয়ে থাকেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে। দেশের বাইরে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা পরিচালনা করছেন মুজিবুল হক। তার বিরুদ্ধে এ বিষয়ে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ উঠেছে। অধিকাংশ সম্পত্তি মন্ত্রীর শাশুড়ি জ্যোৎসা বেগমের নামে দিয়েছেন।

এ ছাড়াও শ্যালক নাসির মুন্সী, শাহপরান মুন্সীসহ অন্যদের নামে- বেনামে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি ক্রয় করা হয়েছে বলে জানা গেছে। মুজিবুল হক চৌদ্দগ্রাম থেকে টানা তিনবারসহ মোট চারবারের সংসদ সদস্য ছিলেন। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি জাতীয় সংসদের হুইপ ছিলেন। ২০১৪ সালের ৬ই জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সরকারের রেলপথমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুজিবুল হক ৬৭ বছর বয়সে দীর্ঘ কুমার জীবনের ইতি টেনে ২০১৪ সালের ৩১শে অক্টোবর হনুফা আক্তার রিক্তাকে বিয়ে করেন।

তিনি ২০১৬ সালের মে মাসে ৬৯ বছর বয়সে প্রথম কন্যাসন্তানের বাবা হন। ২০১৮ সালের ১৫মে তার জমজ সন্তানের জন্ম হয়। সাবেক রেলমন্ত্রী সম্পর্কে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা মানবজমিনকে বলেন, সম্প্রতি সাবেক রেলমন্ত্রীর বিছানায় টাকার দৃশ্য এটা আমাদের কাছে খুব স্বাভাবিক মনে হয়েছে। কারণ তার দুর্নীতি ও সম্পদের পরিমাণ এর চেয়েও শতগুণ বেশি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন তুঙ্গে ঠিক তখনই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দুবাই পাড়ি জমান। মুজিবুলের পরিবার ছিল দরিদ্র এবং কৃষক পরিবার। যেটা তিনি বিভিন্ন সভা সমাবেশে নিজেই বলে বেড়াতেন।

একসময় ভাত খাবার প্লেট না থাকলেও তিনি হুইপ নির্বাচিত হওয়া পর্যন্ত আদর্শগত দিক থেকে পরিচ্ছন্ন ছিলেন। শেষ বয়সে এসে স্ত্রী হনুফাকে বিয়ে করার পর তিনি ধীরে ধীরে দুর্নীতিতে জড়ান। স্ত্রী হনুফা ছিলেন মূলত তার দুর্নীতির ক্যাশিয়ার। এলাকায় ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচন করতে হলে তাকে ২ কোটি টাকা দিয়ে মনোনয়ন নিতে হতো।

এরপর থেকে তার সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের দূরত্ব তৈরি হয়। ঘুষ দুর্নীতির কারণে তিনি স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেন এবং কোনঠাসা হয়ে পড়েন। মুজিবুল হক কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।

এ বিষয়ে জানতে সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুলকে মুঠোফোনে ফোন দিলে বন্ধ পাওয়া যায়। পরে হোয়াটসঅ্যাপে ফোন ও এসএমএস পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি।

সূত্রঃ মানবজমিন

আপনার সামাজিক মাধ্যমে খবরগুলো শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved © 2024
Developed BY www.budnews24.com