চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো, যা তার আগের তিন মাসের তুলনায় ৩৫৩ শতাংশ কম। তবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ২২৩ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বছরের শেষ প্রান্তিকে ব্যাংকগুলো আর্থিক প্রতিবেদন ভালো দেখাতে খেলাপি কমাতে পুনঃতফসিলে ঝোঁকে। ব্যবসায়ীদের চাপ দিয়ে তারা এ সময় নগদ কিছু অর্থ নিয়ে পুনঃতফসিল করে দেয়। যার ফলে বছরের শেষ তিন মাস পুনঃতফসিল ঋণ অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। মার্চ প্রান্তিকে তা আবার স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে আসে। এজন্য চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে পুনঃতফসিল ঋণ কমেছে। এছাড়া আগের মতো চাইলে পুনঃতফসিল করা যাচ্ছে না। এখন ঋণ পুনঃতফসিলের সব নিয়ম মেনেই করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে ব্যাংকগুলো সাত হাজার ৯০৯ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে। গত বছরের শেষ তিন মাসে অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে ৩৫ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা করা হয়। সে অনুযায়ী চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে পুনঃতফসিল কমেছে ২৭ হাজার ৯৪১ কোটি টাকা। আর গত বছরের একই সময়ে (জানুয়ারি-মার্চ) পুনঃতফসিল হয়েছে দুই হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা। সেই হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে পুনঃতফসিল ঋণ বেড়েছে ৫ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণ কমাতে ব্যাংকগুলো মূলত পুনঃতফসিলে ঝুঁকে। ২০২৪ সালে ব্যাংকিং খাতে ৫৬ হাজার ৫৮২ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। ২০২৩ সালে খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয় ৬২ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। যদিও গত বছর সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে তার আগের বছরের তুলনায় খেলাপি ঋণ নবায়ন ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ কমেছে।
পুনঃতফসিল করেও খেলাপি ঋণ কমানো যাচ্ছে না। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে খেলাপি ঋণে রেকর্ড গড়েছে। গত মার্চের শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা মোট ঋণের প্রায় চার ভাগের এক ভাগই ইতিমধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিন মাসের ব্যবধানে বা ডিসেম্বরের তুলনায় মার্চে খেলাপি ঋণ বেড়েছে পৌনে এক লাখ কোটি টাকা। আর এক বছরের হিসাবে বেড়েছে ২ লাখ ৩৮ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, যা মার্চের শেষে বেড়ে হয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরের শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। এর আগে গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকব্যবস্থায় খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছিল ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। গত বছরের শেষ ছয় মাসের (জুলাই-ডিসেম্বর) হিসাবে দেখা যায়, ওই সময়ে খেলাপি ঋণ বাড়ে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে মোট বিতরণ করা ঋণের মধ্যে গত মার্চে খেলাপির হার বেড়ে হয়েছে ৪৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ, যা ডিসেম্বরে ছিল ৪২ দশমিক ৮৩ শতাংশ। অন্যদিকে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণের হার বেড়ে মার্চে ২০ দশমিক ১৬ শতাংশে উঠেছে, যা ডিসেম্বরে ছিল ১৫ দশমিক ৬০ শতাংশ।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এর পর থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। অর্থনীতিবিদেরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করছিলেন যে তৎকালীন সরকারের ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালীরা নানা অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বের করে নিয়েছেন, যার একটা বড় অংশ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।