রবিবার, ০১ জুন ২০২৫, ০৯:৩১ অপরাহ্ন

বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা দেবে জাপান

  • সময়: শনিবার, ৩১ মে, ২০২৫, ৮.৩৯ এএম
  • ১৮ জন

বাংলাদেশকে বাজেট সহায়তা, রেলওয়ে আপগ্রেডেশন ফান্ড ও স্কলারশিপ গ্র্যান্ট হিসেবে ১ দশমিক ০৬৩ বিলিয়ন ডলার দেবে জাপান। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সফরের তৃতীয় দিনে গতকাল শুক্রবার এ সংক্রান্ত চুক্তিপত্র বিনিময় করা হয়।

এদিন দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইশিবা শিগেরু অন্তর্বর্তী সরকারের জাতি গঠন, সংস্কার উদ্যোগ এবং বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ উত্তরণের প্রচেষ্টার প্রতি পূর্ণ সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে জাপানের সর্বাত্মক সহযোগিতা চান প্রধান উপদেষ্টা।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে, মোট অর্থের মধ্যে অর্থনৈতিক সংস্কার ও জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতার জন্য উন্নয়ন নীতি ঋণ হিসেবে ৪১৮ মিলিয়ন ডলার দেবে জাপান। এছাড়া জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী রেল সংযোগকে ডুয়েলগেজ ডাবল রেলপথে উন্নীত করতে টোকিও ৬৪১ মিলিয়ন ডলার এবং স্কলারশিপ বাবদ ৪ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার দেবে।

প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে নিজ নিজ দেশের পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন জাপানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. দাউদ আলী এবং ঢাকায় নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত শিনিচি সাইদা।

সংস্কার কার্যক্রমে পূর্ণ সমর্থন পুনর্ব্যক্ত জাপানের

গতকাল সকালে টোকিওতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে (পিএমও) প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে করেন প্রধানমন্ত্রী ইশিবা শিগেরু। এ সময় তিনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের জাতি গঠন, সংস্কার উদ্যোগ এবং শান্তিপূর্ণ উত্তরণের প্রচেষ্টায় তার দেশের পূর্ণ সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন।

স্বাধীনতার পর থেকে দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্বের কথা স্মরণ করে উভয় পক্ষই দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত অংশীদারত্বের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। উভয় দেশের শীর্ষ নেতৃত্ব সবার জন্য শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে একটি মুক্ত ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক (এফওআইপি) অঞ্চলের জন্য তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বিনিময়ের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।

তারা আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিভিন্ন বিষয় নিয়েও আলোচনা করেছেন এবং জাতিসংঘ সনদের নীতিমালা সমুন্নত রেখে এই অঞ্চল এবং তার বাইরে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। আইনের শাসন এবং গণতন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে বহুপাক্ষিকতার প্রতি সমর্থনের আশ্বাসও দেন তারা।

জাপান-বাংলাদেশ যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বৈঠকে তারা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এবং পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে খোলামেলা ও বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

জাপানের প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের সাময়িকভাবে আশ্রয় দেওয়ার এবং তাদের জন্য অব্যাহত মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করেন। অধ্যাপক ইউনূস ভাসান চরসহ বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের জন্য জাপানের মানবিক সহায়তার প্রশংসা করেন। এ বিষয়ে জাপান তার টেকসই প্রচেষ্টা পুনর্ব্যক্ত করেন।

উভয় পক্ষের অভিমত, বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের মিয়ানমারে একটি টেকসই, নিরাপদ, স্বেচ্ছাসেবী এবং মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন হলো এই সংকটের চূড়ান্ত সমাধান। সংকট সমাধানে সংশ্লিষ্ট সব অংশীদারের মধ্যে আন্তরিক সংলাপের গুরুত্বও স্বীকার করা হয়।

উষ্ণ অভ্যর্থনা ও আতিথেয়তার জন্য ইশিবা শিগেরু এবং জাপানের জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন প্রধান উপদেষ্টা। এ সময় জাপানের প্রধানমন্ত্রীকে পারস্পরিক সুবিধাজনক সময়ে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান তিনি।

বৈঠকে আরো উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়কারী লামিয়া মোরশেদ এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছানোর পর বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টাকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়।

নতুন বাংলাদেশ গড়তে জাপানের সর্বাত্মক সহায়তা

গতকাল টোকিওর জেট্রো সদর দপ্তরে জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো) এবং জাইকা যৌথভাবে ‘বাংলাদেশ বিজনেস সেমিনারের’ আয়োজন করে। এতে প্রধান উপদেষ্টা নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে জাপানের সর্বাত্মক সহযোগিতা চেয়েছেন। তিনি বলেন, আমি এখানে এসেছি আপনাদের ধন্যবাদ জানাতে এবং পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণ করতে। আমরা বড় বিপদের মধ্যে আছি। আক্ষরিক অর্থেই বাংলাদেশ ১৬ বছরের একটি ভূমিকম্প পার করেছে। সবকিছু ভেঙে পড়েছে। আমরা এখন টুকরো টুকরো করে গুছিয়ে তোলার চেষ্টা করছি।

জাপানকে বাংলাদেশের বন্ধু আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলা একটি ঐতিহাসিক চ্যালেঞ্জ। আমরা ইতিহাসকে দেখাতে চাই যে, এটি সম্ভব হয়েছে, তা-ও নিখুঁতভাবে। অন্য একটি বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপন করুন, যাকে আমরা নতুন বাংলাদেশ বলি। তাই আমাদের কাজ হচ্ছে একসঙ্গে সেই নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টি করা। আপনাদের সহযোগিতায় এটি বাস্তবায়নযোগ্য এবং আমরা ইতোমধ্যে তার ভিত্তি স্থাপন করেছি।

মাতারবাড়ী উন্নয়নে সহায়তা করায় জাপানকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ আরো বহু মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের জন্য দরজার মতো যেমন নেপাল, ভুটান ও ভারতের সাতটি উত্তর-পূর্ব রাজ্যের মানুষ সমুদ্রের পথ পেতে পারে বাংলাদেশ হয়ে। মাতারবাড়ী হচ্ছে বাকি বিশ্বের জন্য দরজা। আমরা তাদের জন্য এই দরজা খোলা রাখব।

জাপানের অর্থনীতি, বাণিজ্য ও শিল্পবিষয়ক পার্লামেন্টারি ভাইস মিনিস্টার তাকেউচি শিনজি বলেন, ড. ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশকে একটি কৌশলগত অংশীদার হিসেবে দেখতে চায় জাপান সরকার। তার সরকার দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে বাংলাদেশে, জাপানি কোম্পানিগুলোকে বিনিয়োগে উৎসাহ দিচ্ছে বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশ ও জাপান ছয়টি সমঝোতা স্মারক সই

গতকাল বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে অর্থনৈতিক, বিনিয়োগ ও অন্যান্য সহযোগিতা সংক্রান্ত ছয়টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়েছে। টোকিওতে ‘বাংলাদেশ বিজনেস সেমিনারের’ ফাঁকে প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে এসব সমঝোতা স্মারক সই হয়।

প্রথম সমঝোতা স্মারকটি জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন (জেবিআইসি) এবং বাংলাদেশের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে। এই সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে জেবিআইসি জ্বালানি খাতে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উভয় দেশের মধ্যে সহযোগিতা আরো জোরদার হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

দ্বিতীয় সমঝোতা স্মারকটি ছিল অনোডা ইনক ও বাংলাদেশ এসইজেড লিমিটেডের (বিএসইজেড) মধ্যে, এর আওতায় অর্থনৈতিক অঞ্চলে একটি জমি লিজ সংক্রান্ত চুক্তি হয়েছে। অনোডা ইতোমধ্যে জাইকার উদ্যোগে একটি গ্যাস মিটার স্থাপন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে এবং এখন সেখানে গ্যাস মিটারের অ্যাসেম্বলি ও রক্ষণাবেক্ষণ কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা করছে।

তৃতীয় সমঝোতা স্মারকটি ছিল বাংলাদেশ নেক্সিস কো. লিমিটেড এবং বাংলাদেশ এসইজেড লিমিটেডের মধ্যে অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি লিজ সংক্রান্ত। এই চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ নেক্সিস কো. অর্থনৈতিক অঞ্চলে একটি কারখানায় গার্মেন্টস এক্সেসরিজ উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে।

চতুর্থ সমঝোতা স্মারকে গ্লাগিট, মুসাসি সিমিতিসু ইন্ডাস্ট্রি গ্লাফিট এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) মধ্যে ব্যাটারিচালিত বাইসাইকেল ও বৈদ্যুতিক মোটরসাইকেল তৈরির একটি কারখানা স্থাপন বিষয়ক সহযোগিতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

পঞ্চম সমঝোতা স্মারকটি কিপার কোর কো. লিমিটেডের সঙ্গে, যারা বাংলাদেশে ২ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে তথ্য নিরাপত্তায় তাকাতোশি নাকামোরা পুরস্কারপ্রাপ্ত পূর্ণাঙ্গ কিপার প্রযুক্তি’র ভিত্তিতে একটি জাতীয় পাইলট প্রকল্প শুরু করতে যাচ্ছে।

এই প্রকল্পের লক্ষ্য হলো বাংলাদেশকে একটি কোয়ান্টাম-প্রতিরোধী ডিজিটাল অর্থনীতিতে রূপান্তর করা। প্রযুক্তির প্রয়োগ ও বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণের একচেটিয়া অধিকার স্থানীয় প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করা হয়েছে।

ষষ্ঠ সমঝোতা স্মারকটি জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ও বিডার মধ্যে। এই চুক্তির মাধ্যমে জাইকা একীভূত সিঙ্গেল উইন্ডো প্ল্যাটফর্মের (আইএসডব্লিউপি) প্রাথমিক উন্নয়নে কারিগরি ও অন্যান্য সহযোগিতা প্রদান করবে।

এই প্ল্যাটফর্মটি বিডার নেতৃত্বে গঠিত, যার লক্ষ্য হলো বাংলাদেশের বিভিন্ন বিনিয়োগ উন্নয়ন সংস্থার সেবাকে এক-দরজায় একত্রিত করা।

পৃথিবীকে রক্ষায় তরুণদের ‘থ্রি জিরো ক্লাব’ গড়ার আহ্বান

গতকাল জাপানের সোকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি গ্রহণ করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সামাজিক উদ্ভাবন এবং বৈশ্বিক উন্নয়নে তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে এ সম্মানসূচক ডিগ্রি দেওয়া হয়।

সেখানে পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে তরুণদের ‘থ্রি জিরো ক্লাব’ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, আমরা যে সভ্যতা তৈরি করছি, তা একটি আত্মবিধ্বংসী সভ্যতা, যা পৃথিবীকে ধ্বংস করবে। বর্তমান সভ্যতার কাঠামোর মধ্যে মানুষ টিকে থাকতে পারবে না, কারণ বিশ্বজুড়ে পরিবেশ ধ্বংস অব্যাহত আছে।

‘থ্রি জিরো থিওরি’ বা তিন শূন্য তত্ত্ব— শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব, শূন্য নিট কার্বন নিঃসরণ-এর কথা উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এখন সবাই কেবল তাদের মুনাফা সর্বাধিক করতে চাচ্ছে। পাঁচজন ব্যক্তি একত্রিত হয়ে একটি থ্রি জিরো ক্লাব গঠন করতে পারে, যেখানে তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকবে যে তারা জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করবে না।

জাপান প্রবাসীদের সঙ্গে মতবিনিময়

জাপানে বসবাসরত বাংলাদেশিদের সঙ্গে গতকাল মতবিনিময় করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। টোকিওতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে এই মতবিনিময় অনুষ্ঠানে শতাধিক বাংলাদেশি যোগ দেন। চার দিনের সফর শেষে আজ শনিবার সকালে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে টোকিও ত্যাগ করবেন প্রধান উপদেষ্টা।

সিঙ্গাপুর হয়ে রাতেই ঢাকায় পৌঁছানোর কথা রয়েছে তার। গত ২৭ মে জাপানে সরকারি সফরে টোকিও পৌঁছান তিনি।

আপনার সামাজিক মাধ্যমে খবরগুলো শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved by BUD News 24-2025
Developed BY www.budnews24.com