রাজধানী ঢাকা গতকাল পরিণত হয়েছিল বিশাল এক জনসমুদ্রে। তৌহীদি জনতার ঢল নেমেছিল ঢাকায়। মানুষের সব পথ মিলেছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ‘মার্চ ফর গাজা’ র্যালিতে লাখো জনতার উপস্থিতি জানান দিয়েছে ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মানুষের সঙ্গে আছে গোটা বাংলাদেশ।
অসহিংস ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে বাংলার মানুষ সব ধরনের সহিংসতা ও হত্যাযজ্ঞকে ‘না’ করে দিয়েছে। আয়োজকরা বলেছেন, গাজার পক্ষে এটি বিশ্বের বৃহত্তম জমায়েত। সমাবেশে তারা বলেন, বাংলাদেশের সব দল, মত, চিন্তা ও দর্শনের মানুষ মজলুম ফিলিস্তিনের পাশে আছে, সহাবস্থান করছে। লাখো কণ্ঠে আওয়াজ উঠেছিল ‘ফ্রি ফ্রি প্যালেস্টাইন’ (মুক্ত কর ফিলিস্তিন)।
‘প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট বাংলাদেশ’-এর উদ্যোগে এ র্যালি অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, আলেম-ওলামাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচিতে একাত্মতা প্রকাশ করে এতে অংশগ্রহণ করেন। ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সংহতি ও ইসরাইলের বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ঢাকার চারদিক থেকে মিছিল নিয়ে সর্বস্তরের মানুষ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এ র্যালিতে সমবেত হয়েছিলেন। দেশের সব অঞ্চল থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষ এ র্যালিতে অংশ নেন।
বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খতিব মাওলানা আবদুল মালেক এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। অনুষ্ঠানে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং গাজায় গণহত্যা বন্ধের দাবিসহ ফিলিস্তিনের জনগণকে রক্ষা ও নিরাপত্তার দাবি জানানো হয়। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আদালতে অঞ্চলটিতে চলমান ইসরাইলি গণহত্যার বিচার দাবি করা হয়।
আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান অনুষ্ঠানে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশের জনগণ গাজার পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা এবং ইসরাইলের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করতে মুসলিম বিশ্বের নেতাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এ ছাড়া গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন বন্ধের দাবি জানানো হয়। ঘোষণাপত্রে চারটি স্তরে দাবি উপস্থাপন করা হয়। দাবিগুলো হলোÑ জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি; মুসলিম উম্মাহর প্রতি; বাংলাদেশ সরকারের প্রতি এবং নিজেদের জন্য অঙ্গীকারনামা।
‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচির নির্ধারিত সময় বেলা ৩টা হলেও সকাল থেকেই মিছিলসহকারে মানুষ সমাবেশস্থলে জড়ো হতে শুরু করে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জনতার উপস্থিতি বাড়তে থাকে। দুপুরে ঢাকার চারপাশ যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, গাবতলী এবং মিরপুর, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, বাংলামোটর ও শাহবাগ এলাকা হয়ে একের পর এক মিছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে যেতে দেখা যায়। খোলা ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানে করে তরুণদের স্লোগান দিতে দিতে উদ্যানের দিকে যেতে দেখা যায়।
অসংখ্য নারী-শিশুকে এ কর্মসূচিতে অংশ নিতে দেখা গেছে। এ সময় মানুষের হাতে হাতে দেখা গেছে বাংলাদেশ ও ফিলিস্তিনের জাতীয় পতাকা। তাদের মাথায় বাঁধা ছিল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ লেখা কাপড়। মুখে মুখে ছিল নানা স্লোগান। ফিলিস্তিনের বিশাল বিশাল পতাকার চারদিকে ধরে মিছিলসহকারে হাজারো জনতাকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অভিমুখে যাত্রা করতে দেখা যায়। দুপুর ২টার মধ্যেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছাপিয়ে আশপাশের সব সড়কে জনতার ঢল ছড়িয়ে পড়ে। এতে চারদিকে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আগত লোকজনের তৃষ্ণা মেটাতে এগিয়ে আসে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাসেবক দল। তারা পিকআপে করে বিনামূল্যে পানি, বিস্কুট ও কেক বিতরণ করে।
এ কর্মসূচিকে ঘিরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আশপাশসহ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্যকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। নিরাপত্তা তল্লাশির জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রবেশপথগুলোয় আর্চওয়ে স্থাপন করা হয়। সন্দেহজনক আগতদের তল্লাশি করা হয়।
গণজমায়েতকে কেন্দ্র করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঠিক পশ্চিম-পূর্ব প্রান্তের চত্বরে উত্তরমুখী করে তৈরি করা হয় খোলা মঞ্চ। এর সামনে লাল কার্পেট বিছানো হয়। সেখানে অতিথিদের বসার জন্য শতাধিক চেয়ারের ব্যবস্থা করা হয়। মঞ্চের চারপাশ ঘিরে বাঁশ দিয়ে নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরি করা হয়। উদ্যানের চারপাশের এলাকা এবং শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, মৎস্য ভবন, দোয়েল চত্বরসহ পুরো এলাকায় মাইক লাগানো হয়।
বেলা সোয়া ৩টার দিকে বিখ্যাত কারি আহমদ বিন ইউসুফের কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে এ কর্মসূচির আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। অনুষ্ঠানের সভাপতি জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মুফতি আব্দুল মালেকের দোয়া ও মোনাজাত পরিচালনার মধ্য দিয়ে কর্মসূচির সমাপ্তি হয়।
এর আগে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বাংলাদেশের সব দল, মত, চিন্তা ও দর্শনের মানুষ মজলুম ফিলিস্তিন ও গাজার পাশে আছে, সহাবস্থান করছে মন্তব্য করে গণজমায়েতে আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শায়খ আহমাদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা এক কাতারে দাঁড়িয়ে আজ বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিতে চাই, আমাদের মধ্যে বিভিন্ন চিন্তা, মতগত পার্থক্য, ভিন্নতা থাকতে পারে; কিন্তু মজলুম ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা ও ভূমির অধিকারের দাবিতে আমরা বাংলাদেশের মানুষ ধর্ম, বর্ণ-নির্বিশেষে প্রত্যেকে তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করছি।
ইসলামিক বক্তা মিজানুর রহমান আজহারী স্লোগানে স্লোগানে ফিলিস্তিনের ভাইদের প্রতি সংহতি প্রকাশের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ভৌগোলিকভাবে আমরা ফিলিস্তিন থেকে অনেক দূরে হতে পারি, কিন্তু আজকের এই জনসমুদ্র প্রমাণ করে আমাদের হৃদয়ে বাস করে একেকটা ফিলিস্তিন, আমাদের হৃদয়ে বাস করে একেকটা গাজা, আমাদের হৃদয়ে বাস করে একেকটা আল কুদস।
আজকের এই জনসমুদ্র ফিলিস্তিন ও আল আকসার প্রতি বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ বলে উল্লেখ করেন আজহারী। তিনি বলেন, আজকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, এই গণজমায়েতে, এই জনসমুদ্রে উপস্থিত হয়ে আমরা বুঝতে পেরেছি, আজকের এই মহাসমুদ্র, জনসমুদ্র ফিলিস্তিনের প্রতি, আল আকসার প্রতি বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
এদিকে কর্মসূচির ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশি পাসপোর্টে এক্সেপ্ট ইসরাইল পুনর্বহালের দাবি করা হয়। ঘোষণাপত্রে ড. মাহমুদুর রহমান উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র, যার স্বাধীনতা-সংগ্রামের ভিত্তিতেই নিহিত রয়েছে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের চেতনা।
তিনি বলেন, আমরা বিশ্বাস করি ফিলিস্তিন প্রশ্নে বাংলাদেশ কেবল মানবতার নয়, ঈমানের পক্ষেও এক ঐতিহাসিক অবস্থানে আছে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে সরকারের দায়িত্ব জনগণের ঈমানি ও নৈতিক আকাঙ্ক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা রাখা। বাংলাদেশের জনগণ গাজার পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছে।
মার্চ ফর গাজা কর্মসূচির অনুষ্ঠান মঞ্চে অন্যদের মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমির মুফতি ফয়জুল করিম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মামুনুল হক, লতিফুল ইসলাম শিবলী, মাহমুদুল হাসান সোহাগ, অধ্যাপক মোকতার আহমেদ, মুফতি সাখাওয়াত হোসেন, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব সাজিদুল ইসলাম, এনসিপির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ ইউনুস, নেছারাবাদের পীরসাহেব মাওলানা খলিলুর রহমান নেছারাবাদী, নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন, মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, মাওলানা হাসান জামিল, মাওলানা জুনায়েল আল হাবীব, মুফতি মিজানুর রহমান সাইদ, কবি মুহিব খান, কারি আহমেদ বিন ইউসুফ, রাশেদ প্রধান, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব অধ্যাপক আহমেদ আব্দুল কাদের, বেফাকুল মাদারিসুল আরাবিয়্যার মহাসচিব মাহফুজুল হক, এবি পার্টির সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন মাহমুদ, নুরুল ইসলাম বুলবুল, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গভর্নিং বোর্ডের সভাপতি সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল-মাদানী, জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগর উত্তরের আমির, ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আব্দুস সালাম, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
আয়োজকদের অন্যতম সাইফুল ইসলাম আমার দেশকে বলেন, আমরা মনে করি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অভূতপূর্ব জমায়েত হয়েছে। দলমতনির্বিশেষে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে এমন জমায়েত বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল।
পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) এক কর্মকর্তা আমার দেশকে জানান, তাদের তথ্যমতে র্যালিতে ১১ লাখের মতো মানুষ উপস্থিত ছিল।
জমায়েতে ১০ লক্ষাধিক উপস্থিত ছিল এমন দাবি করে তিনি বলেন, ফিলিস্তিনিদের পক্ষে বিশ্বে কোথাও এতবড় জমায়েত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। বিশ্বে হয়তো এর থেকে বড় সমাবেশ হতে পারে, তবে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে এটি সম্ভবত সব থেকে বড় জমায়েত।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস্ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, কর্মসূচিকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল রাখতে আমরা পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করি। এ কর্মসূচিকে ঘিরে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর আমরা পাইনি।