মঙ্গলবার, ০১ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৫৮ পূর্বাহ্ন

রাজস্বে পরোক্ষ কর নির্ভরতায় মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট মানুষ

  • সময়: শনিবার, ১ মার্চ, ২০২৫, ৩.৩২ পিএম
  • ৫২ জন

রাজস্ব আয়ে পরোক্ষ করের ওপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে সরকার। আয়ের দুই-তৃতীয়াংশই আদায় হয় এ খাত থেকে। পরোক্ষ করের কারণে মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট সাধারণ মানুষ। কিন্তু তারপরও রাজস্ব আদায়ে মূল হাতিয়ার হিসেবে পরোক্ষ করই ব্যবহার করছে সরকার।

এনবিআরের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, বিগত চার অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের ৬৭ শতাংশই এসেছে পরোক্ষ কর থেকে, বিপরীতে ৩৩ শতাংশ আয় হয়েছে প্রত্যক্ষ কর থেকে। অবশ্য একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ৮০ শতাংশ আয়ই আসত পরোক্ষ করের খাত থেকে। সে হিসাবে রাজস্ব আয়ে প্রত্যক্ষ করের তুলনায় পরোক্ষ করের হার কমছে।

কিন্তু বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাজস্ব আয়ে পরোক্ষ করের হার আরো কম হওয়া উচিত। পরোক্ষ করের হার ৩০ শতাংশের কম থাকা উচিত। কিন্তু রাজস্ব আয়ে উল্টোপথেই হাঁটছে সরকার। সরকারের পরোক্ষ করের ওপর অধিক নির্ভরশীলতায় প্রতিনিয়ত নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। কারণ ধনী-দরিদ্র সবাইকে একই হারে ভ্যাট প্রদান করতে হয়। কিন্তু দরিদ্র কিংবা নিম্নবিত্তের মানুষের ওপর পরোক্ষ করের অভিঘাত অনেক বেশি।

এমনিতেই সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা খুবই কম। পরোক্ষ করারোপ কিংবা বাড়ানো হলে পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়ে যায়। আয়কর প্রদান না করলেও দেশে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ও ভোক্তা হিসেবে দরিদ্র শ্রেণির মানুষ মূসক, পণ্য আমদানিতে পরোক্ষ কর, সম্পূরক শুল্কসহ অন্যান্য ভ্যাট, চার্জ হিসেবে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে কর দেয়। অর্থাৎ জাতীয় বাজেটেও দরিদ্র শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি। এনবিআরের কর আহরণ সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আয়বৈষম্য কমিয়ে কর ন্যায্যতা ও প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা জরুরি। ভ্যাটের মতো পরোক্ষ করভিত্তিক রাজস্ব বাংলাদেশের মতো অর্থনীতির জন্য আদর্শ নয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপের তথ্যানুযায়ী, দেশের ৩০ শতাংশ সম্পদ রয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ ধনীর হাতে। বাকি ৭০ শতাংশ আয় ৯৫ শতাংশ মানুষের হাতে। ধনী ও গরিবের সম্পদের এই তীব্র বৈষম্য তৈরি হলেও সম্পদশালীদের তুলনায় সম্পদহীন লোকেরাই পরোক্ষ করের কারণে বেশি কর দিচ্ছেন। সম্পদশালী লোকের আয়ের ওপর করের হার বাড়ানো হলে একদিকে সম্পদের বৈষম্য কমত একই সঙ্গে গরিব বা নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর চাপ কমত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রসঙ্গত, কোনো পণ্য বা সেবার ওপর আরোপিত মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), সম্পূরক শুল্ক, আবগারি শুল্ক ইত্যাদি পরোক্ষ কর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির আয়ের ওপর যে করারোপ করা হয় তা প্রত্যক্ষ কর।

এনবিআরের সাবেক সদস্য ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী আমার দেশকে বলেন, পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহে প্রত্যক্ষ কর থেকেই সরকার বেশি রাজস্ব আয় করে। কিন্তু আমাদের দেশে উল্টো চিত্রই দেখা যাচ্ছে। প্রচুর মানুষ বিলাসী জীবনযাপন করছে, বিলাসী গাড়ি ব্যবহার করছে।

কিন্তু এদের কতজন ঠিকমতো আয়কর দেন, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোও ব্যাপকহারে কর ফাঁকি দিয়ে আসছে। এ কারণে প্রত্যক্ষ কর বাড়ছে না। পরোক্ষ করের কারণে পণ্য বা সেবার ওপর সরাসরি প্রভাব পড়ে এতে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ তৈরি হয়।

পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ আমার দেশকে বলেন, বাংলাদেশে একসময়ে বেসরকারি খাতের তেমন প্রসার ছিল না, ব্যক্তিশ্রেণির প্রাতিষ্ঠানিক কাজের সুযোগও কম ছিল। তখন পরোক্ষ করের অংশ বেশি থাকাটা অস্বাভাবিক ছিল না।

কিন্তু বর্তমানে বেসরকারি খাতের প্রসার হয়েছে, প্রাতিষ্ঠানিক কর্মের অনেক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এ হিসাবে প্রত্যক্ষ কর থেকে সরকারের রাজস্ব আয় বেশি হওয়া উচিত। পরোক্ষ করের কারণে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপে পড়ে। এ কারণে তাদের জীবনযাত্রার মান কমে যায়।

প্রত্যক্ষ কর না বাড়ার কারণ হিসেবে এ বিশ্লেষক বলেন, করযোগ্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কর আদায়ে এনবিআরের যেমন গাফিলতি রয়েছে, তেমনি করদাতারাও নানা ধরনের হয়রানির কারণে কর দেওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহবোধ করেন না। প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে করজাল বিস্তৃত এবং করযোগ্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যাতে কর প্রদানে কোনো ধরনের হয়রানির শিকার না হয়, সেটি নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন মাসরুর রিয়াজ।

এনবিআরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে আমার দেশকে বলেন, ভ্যাট আরোপের কারণে সাধারণ মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিষয়টি এমন নয়। তিনি মোবাইল ফোনের উদাহরণ দিয়ে বলেন, একজন সাধারণ লোক একটি মোবাইল যদি ১০ হাজার টাকায় কেনেন এবং ১৫ শতাংশ ভ্যাটের কারণে তিনি ১ হাজার ৫০০ টাকা ভ্যাট নেবেন। কিন্তু একজন ধনী ব্যক্তি হয়তো এক লাখ টাকার ফোন কিনবেন। সে ক্ষেত্রে তিনি ১৫ শতাংশ হারে ১৫ হাজার টাকা ভ্যাট দেবেন। ভ্যাটের হার সমান হলেও দুইজন ব্যক্তির ভ্যাটের পরিমাণ ভিন্ন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মোবাইল বা এ জাতীয় কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে এ ধরনের ভিন্ন প্রভাব রয়েছে। কিন্তু বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির ওপর যখন ভ্যাট বা শুল্ক আরোপ করা হয়, তখন নিম্নবিত্তের লোকজনকেও উচ্চবিত্তের লোকজনের মতো একই দরে তা কিনতে হচ্ছে। ফলে নিম্নবিত্ত বা দরিদ্রশ্রেণির লোকদের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি হয়। ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ পণ্য বা সেবার ক্ষেত্রে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাইকে একই পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়। সাধারণ মানুষের ওপর থেকে মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে পরোক্ষ করের বোঝা কমাতে হবে বলে মনে করছেন তারা।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের শুল্ক বিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা ও বারভিডার প্রেসিডেন্ট আবদুল হক আমার দেশকে বলেন, প্রত্যক্ষ কর আদায়ে সৃজনশীল কোনো উদ্যোগ নেই। গতানুগতিক উপায়ে কর আদায় করা হয়। প্রত্যক্ষ করের প্রায় ৮০ শতাংশই আসছে উৎস কর হতে। বাকি ২০ শতাংশ আসছে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের আয়ের ওপর আয়কর হিসেবে।

অথচ আয়কর আইন অনুযায়ী, ঢাকা শহরে বসবাসরত ৭০ শতাংশ আয়করের আওতায় থাকলেও খুব কম লোকই আয়কর দিয়ে থাকে। আয়কর না দেওয়ার কারণ হিসেবে বলেন, সাধারণ মানুষ সরকারের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সেবা পাচ্ছে না। এ ছাড়া করদাতারা নানা ধরনের হয়রানি কিংবা নিগৃহীত হন। রাজস্ব আয় বাড়াতে ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এসএমএসি অ্যাডভাইজরি সার্ভিস লিমিটেডের পরিচালক ও বিশিষ্ট চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট স্নেহাশীষ বডুয়া আমার দেশকে বলেন, দেশে ৪০ লাখ লোক আয়কর রিটার্ন জমা দেন। এর মধ্যে ১০ থেকে ১৫ লাখ লোক কোনো আয়কর দেন না। বাকি যারা আয়কর দেন, তারাও যে সম্পদের সঠিক হিসাব অনুযায়ী আয়কর দেন, তা বলা কঠিন। মানুষের আয় বাড়ছে, সম্পদ বাড়ছে কিন্তু সরকারের রাজস্ব সেভাবে বাড়ছে না। সরকারের আয় বাড়াতে করজাল বিস্তৃত করতে হবে।

আপনার সামাজিক মাধ্যমে খবরগুলো শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved by BUD News 24-2025
Developed BY www.budnews24.com