জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগকে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক মনে করছে বিএনপি। একইসঙ্গে রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের পক্ষে থাকলেও দলটির অভিমত হচ্ছে- আপাতত অপ্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাব জটিলতা আরো বাড়াবে। এ নিয়ে শিগগির অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে তা তুলে ধরবে বিএনপি।
গত সোমবার অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এই অভিমত ব্যক্ত করেন বিএনপির নীতি নির্ধারকরা।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, প্রধান উপদেষ্টার ডাকা সর্বদলীয় সভায় বিএনপির প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণকারী স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ যে বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন তা উল্লেখ করে জানান, যেকোনো অভ্যুত্থান-আন্দোলনের রাজনৈতিক দলিল প্রণয়নে রাজনৈতিক মতৈক্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, একইসঙ্গে এর আইনি ভিত্তি কী হবে, সে ব্যাপারেও আলোচনা-পর্যালোচনার প্রয়োজন আছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান এবং অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের এত সময় পরে কেন এই উদ্যোগ, সেটাও তিনি জানতে চান।
বিএনপির কয়েকজন নীতিনির্ধারক জানান, তারা বৈঠকে বলেছেন, বর্তমান সরকার গঠিত হয়েছে একটি ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’র ভিত্তিতে। এখন সরকার প্রতিষ্ঠার প্রায় পাঁচ মাস পর কেন ঘোষণাপত্র তৈরির প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হলো- যা সম্পূর্ণভাবে অপ্রাসঙ্গিক। এখন এর কোনো প্রয়োজন আছে বলে তারা মনে করেন না। যদি তারা সে সময় এ ধরনের কোনো ডিক্লারেশন (ঘোষণা) তৈরির কথা বলত, সেটি নিয়ে তখন হয়তো একটা রাজনৈতিক মতৈক্য তৈরি হতে পারত।
স্থায়ী কমিটির সদস্যরা মনে করেন, দেশ ও সরকারকে অস্থিতিশীল করতে নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে। এর বাইরেও বিতর্ক সৃষ্টির নানা অপচেষ্টা আছে। এর আগেও সংবিধান বাতিল করার দাবি এসেছে। এর পরপরই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে। রাজনৈতিক মতৈক্য না হলে এটিও এক ধরনের বিতর্ক-বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা।
জানা গেছে, স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সরকার রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারে যে বিভিন্ন কমিশন তৈরি করেছে, তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। নেতারা বলেন, বিএনপি সময়ের চাহিদাকে বিবেচনায় নিয়ে রাষ্ট্র সংস্কার করার জন্য প্রথমে ২০২২ সালে ২৭ দফা এবং পরের বছর ২০২৩ সালে সমমনা দলগুলোর মতামত নিয়ে ৩১ দফা রূপরেখা দিয়েছে। এই ৩১ দফাই হচ্ছে রাষ্ট্র সংস্কারের সবচেয়ে বড় দলিল। এমনকি সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের এই উদ্যোগ নেওয়ার পরে তারা নিজেরাও দলীয়ভাবে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কী ধরনের সংস্কার আনা যেতে পারে, সেসব সুপারিশ তারা ইতোমধ্যে কমিশনের কাছে তুলে দিয়েছে।
কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে সরকারের উদ্যোগে শিগগির যে রাজনৈতিক সংলাপ হবে, যেখানে এ বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার আশা করছে বিএনপি। রাজনৈতিক মতৈক্যের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় প্রস্তাবগুলো গৃহীত হবে।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন দেশের পুরোনো চারটি বিভাগকে চারটি প্রদেশ করার যে সুপারিশ দেওয়ার কথা ভাবছে তা অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করে বিএনপি। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নীতিনির্ধারকরা এ নিয়ে বলেন, বাংলাদেশে এটার কোনো বাস্তবতা নেই। বরং নানান ধরনের জটিলতা বাড়াবে। অঞ্চলভেদে বিভিন্ন উগ্রগোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেÑযারা সেখানে নিজেদের টেরিটোরি ঘোষণা করতে পারে।
যেগুলোর ওপর একটা পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ রাখা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে এ ধরনের উদাহরণ আছে। ফলে এটা বিতর্ক আরো বাড়াবে এবং রাষ্ট্রের যে অস্তিত্ব, সেটাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। তাই এটার কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে বলে বিএনপি মনে করে না।
উল্লেখ্য, প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছাড়া অন্যান্য বিষয়ের ব্যবস্থাপনা প্রদেশের হাতে দেওয়ার পক্ষে। এই চার প্রদেশ হলো- ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা। কমিশন তাদের এই প্রস্তাব আগামী ৩১ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করবে।
বৈঠকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন।