মসলাজাতীয় পণ্য পেঁয়াজের চাহিদা দেশে অনেক। ৩৮ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন ৩৫ লাখ টন হলেও বাজারে আসে ২৬ থেকে ২৭ লাখ টন। ফলে ১০ থেকে ১১ লাখ টন আমদানি করতে হয়। এতদিন আমদানির ৯০ শতাংশ আনা হতো ভারত থেকে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর উন্মুক্ত পদ্ধতিতে বাজার অনুসন্ধান শুরু করে ৮টি দেশ থেকে আনা হচ্ছে।
গত ৬ মাসে এই ৮টি দেশ থেকে ১৩ হাজার ৫৯৬ দশমিক ৬৩ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে পাকিস্তান থেকে আনা হচ্ছে আমদানির ৪৭ শতাংশ। এভাবে দেশটি হয়ে উঠেছে পেঁয়াজ আমদানির একটি নির্ভরযোগ্য উৎস।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবমতে, দেশে ৩৫ লাখ টনের কাছাকাছি পেঁয়াজ উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ উৎপাদন ও সংরক্ষণ পর্যায়েই নষ্ট হয়ে যায়। বাজারে আসে ২৬ থেকে ২৭ লাখ টন । ১০ থেকে ১১ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা মেটাতে হয় আমদানি করে। এতদিন যার ৯০ শতাংশই আনা হতো ভারত থেকে। বিভিন্ন সময় রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা, শুল্ক বাড়িয়ে দেওয়াসহ নানান অজুহাতে দেশের বাজারে কৃত্তিম সংকট তৈরি করে ফায়দা লুটতেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। ফলে বিকল্প বাজারের সন্ধানে ছিলেন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা। কিন্তু বিগত সরকারের অনাগ্রহে ভারতের ওপরই নির্ভরশীল থাকতে হতো। অতীতে তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়ার মতো দূরবর্তী দেশ থেকে আমদানির সুযোগ পেয়েছিলেন তারা। কিন্তু বাংলাদেশের তুলনায় এসব পেঁয়াজের মান ও স্বাদ ভিন্ন হওয়ায় বাজারে স্থায়িত্ব পায়নি। ভারতকে একতরফা বাজার দিতে কাছের দেশগুলো থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি পাননি আমদানিকারকরা।
আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর উন্মুক্ত পদ্ধতিতে বাজার অনুসন্ধান শুরু করেন আমদানিকারকরা। এতে সহজলভ্য বাজারের সন্ধান পায় পাকিস্তানে। পাকিস্তান ছাড়াও মিসর, মিয়ানমার, চীন, নিউজিল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, তুরস্ক ও থাইল্যান্ড থেকেও আমদানি করা হচ্ছে পেঁয়াজ। গত ৬ মাসে এই ৮টি দেশ থেকে ১৩ হাজার ৫৯৬ দশমিক ৬৩ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে শুধু পাকিস্তান থেকিই আমদানি হয়েছে ৬ হাজার ২৯১ টন, যা আমদানির ৪৭ শতাংশ। সম্প্রতি পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের জাহাজ চলাচল শুরু হওয়ায় পেঁয়াজের বড় বিকল্প হয়ে উঠেছে দেশটি।
খাতুনগঞ্জের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী ইলিয়াস হোসেন জানান, ভারত থেকে আসা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকা কেজি দরে। বিপরীতে পাকিস্তানি পেঁয়াজের দাম ৪৫ টাকা করে। সস্তার এই বাজার বহু আগে শনাক্ত করলেও বিগত সরকারের আমলে অঘোষিতভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করা হতো। এতে পাকিস্তানি কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে এলসি করার অনুমোদন পেতেন না তারা। ফলে দূরের দেশ থেকে আমদানি করতে হতো। এতে কৃত্তিমভাবে ভারতীয় পেঁয়াজের স্থায়ী বাজার তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশে। আমদানিকারকরা জানান, দেশে এক বছর ধরে খুচরা পর্যায়ে পেঁয়াজের দাম প্রতি কেজি ১০০ টাকারও বেশি চলছিল। জুলাই বিপ্লবের পর বন্যার কারণে হঠাৎ করে ভারতের বাজারেও দাম বেড়ে যায় পেঁয়াজের। বিকল্প বাজার থেকে আমদানির মাধ্যমে বাজারের স্থিতিশীলতার চেষ্টায় ছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ সুযোগে কাছের বাজার পাকিস্তানকেই বেছে নেন আমদানিকারকরা।
চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কেন্দ্রের পরিসংখ্যন বলছে, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে পাকিস্তান, মিসর, চীন ও থাইল্যান্ড থেকে ৬৭৭ দশমিক ২২ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। আগস্টে পাকিস্তান, মিসর ও চীন থেকে ৪ হাজার ৫০২ দশমিক ৭৫ টন আমদানি হওয়া পেঁয়াজের ৩ হাজার ৩৪৩ দশমিক ৭৫ টনই এসেছে পাকিস্তান থেকে। সেপ্টেম্বরে চারটি দেশ (পাকিস্তান, মিসর, চীন ও মিয়ানমার) থেকে দুই হাজার ২৬৩ দশমিক ২২ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়। যার মধ্যে এক হাজার ৩৩৮ দশমিক ২২ টন পাকিস্তানের। এছাড়া অক্টোবরে আমদানি হওয়া ৩ হাজার ৩৭৪ দশমিক ৭৭৫ টন পেঁয়াজের মধ্যে পাকিস্তান থেকে আসে ৬৪১ দশমিক ৭০ টন। নভেম্বরে দুই হাজার ৩৭২ দশমিক ৩৬ টন আমদানি করা পেঁয়াজের ৭৫৪ টনই পাকিস্তান থেকে এসেছে। তবে নভেম্বর থেকে রবিশস্য মৌসুম শুরু হওয়ায় দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ শুরু হলে বিকল্প উৎসের দেশগুলো থেকে আমদানি অনেক কমে যায়।
কৃষি বিভাগ বলছে, বর্তমানে ফরিদপুর, পাবনা, রাজবাড়ী, রাজশাহী জেলার পেঁয়াজের সরবরাহ রয়েছে। দুই সপ্তাহ আগে ভারত থেকে চাহিদার তুলনায় বাড়তি আমদানির কারণে পাইকারিতে দাম অস্বাভাবিক কমে যায়। ওই সময় পেঁয়াজের দাম কমে কেজিপ্রতি ৪০ টাকায় নেমে যায়। এতে লোকসানে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয় কৃষকের। তবে সরকার কঠোরভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করায় ধীরে ধীরে দাম বেড়ে বর্তমানে সর্বোচ্চ ৬০ টাকার কাছাকাছি বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ।
খাতুনগঞ্জের মেসার্স আসলাম ট্রেডার্সের মালিক আসলাম মিয়া জানান, পেঁয়াজ পচনশীল পণ্য হওয়ায় পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে আমদানিতে আগ্রহ ব্যবসায়ীদের। মিয়ানমার থেকেও বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানির সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ভারতকে একচেটিয়া বাজার দিতে সে দেশ থেকে আমদানি নিরুৎসাহিত করেছে বিগত সরকার। তবে বর্তমানে মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ চলায় সেই সুযোগ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে কাছের দেশ পাকিস্তানই পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠেছে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের জন্য।