আওয়ামী সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনকালে ডজনখানেক ব্যাংকে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। দুর্নীতির মাধ্যমে এসব ব্যাংক থেকে ঋণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে।
কী পরিমাণ ঋণ বেরিয়ে গেছে, এর সুবিধাভোগী কারা, ঋণের গন্তব্য এবং ব্যাংকের সম্পদের মান বের করতে প্রথম ধাপে ছয়টি ব্যাংকে অনুসন্ধান শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গঠিত টাস্কফোর্স টিম। আন্তর্জাতিক দুটি অডিট প্রতিষ্ঠানের সদস্যরাও শিগগিরই যুক্ত হবে এই টিমের সঙ্গে।
ব্যাংকগুলো হলো- ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক। গতকাল সোমবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ছয়টি টাস্কফোর্স টিম ভাগ হয়ে ব্যাংকগুলোতে তদন্ত শুরু করে। আগের দিন ব্যাংকগুলোর এমডিদের সরানোর পরই এই তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
অনুসন্ধান দলের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, টাস্কফোর্স এতদিন আইনি বিষয়গুলো নিয়ে ইন্টারনাল কার্যক্রম করেছে। গতকাল সোমবার থেকে ব্যাংকগুলোতে অডিট শুরু করেছে। প্রথম দিন ব্যাংকের ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে বসা হয়। এ সময় বিভিন্ন তথ্য নেওয়া হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা আমার দেশকে বলেন, ‘যেসব ব্যাংকে অডিট শুরু হয়েছে তাদের পুরো অবস্থা দেখা হবে। অ্যাসেট কোয়ালিটি কী অবস্থায় আছে। কিছু ব্যাংকের খাতা-কলমে অ্যাসেট আছে, বাস্তবে ইনকাম নেই। এসবও দেখা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ব্যাংকগুলোর ঋণ অনিয়মের ঘটনা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন দল বের করবে। এসব প্রতিবেদন টাস্কফোর্সের সঙ্গে সমন্বয় করবে। টাস্কফোর্স এরই মধ্যে একটি খসড়া আইন তৈরি করেছে। এসব ব্যাংককে ক্যাপিটাইলেজ করা হবে নাকি মার্জ করা হবে।
আন্তর্জাতিক দুটো অডিট প্রতিষ্ঠানের সদস্যরাও শিগগিরই যুক্ত হবে এই টিমের তথ্যানুযায়ী, প্রথম ধাপের তদন্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে এতদিন চারটির নিয়ন্ত্রণ ছিল এস আলম গ্রুপের। এস আলম শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।
গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পতনের পর ব্যাংকগুলো থেকে এস আলমের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার আগেই এস আলম হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংকগুলো থেকে বের করে নিয়েছে।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তথ্যানুযায়ী, এস আলম ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে ৩৯ হাজার কোটি টাকার ঋণের নামে টাকা সরিয়েছে, যা ব্যাংকের মোট ঋণের প্রায় ৭৫ শতাংশ। ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে নিয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা, যা ব্যাংকের মোট ঋণের ৮০ শতাংশ। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক থেকে নিয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা, ব্যাংকের মোট ঋণের ৯২ শতাংশ। এ ছাড়া সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ২০১৭ সালে এস আলম গ্রুপের কাছে যায়। ব্যাংকটি থেকে এস আলম গ্রুপ নামে ও বেনামে ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা নিয়ে গেছে।
এক্সিম ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ছিল এতদিন নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের কাছে। তিনি আওয়ামী লীগের ১৫ বছর মেয়াদের পুরো সময়ে ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবির চেয়ারম্যান ছিলেন। এর প্রভাবে নামে-বেনামে ব্যাংকটি থেকে টাকা তুলে নেওয়া হয় বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক আগে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক নামে পরিচিত ছিল। তখন এটি ছিল ওরিয়ন গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। নানা অনিয়মের কারণে ব্যাংকটিতে প্রশাসক বসায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে বিদেশিরা মালিকানা নিলেও ব্যাংকটি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। তথ্যানুযায়ী, আর্নেস্ট অ্যান্ড ইয়াং নিরীক্ষা করবে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের সম্পদের মান। কেপিএমজি নিরীক্ষা করবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংকের সম্পদের মান।