বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ ব্যাপকভাবে পরিশোধ করায় এ খাতে ঋণের স্থিতি কমতে শুরু করেছে। চার মাসে এ খাতে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি কমেছে ১২১ কোটি ডলার বা প্রায় ১১ শতাংশ। নভেম্বরে এ ঋণের স্থিতি কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১১ কোটি ডলারে। তবে নিট হিসাবে স্থিতি আরও কমেছে। জুলাইয়ে ছিল ১ হাজার ১৩২ কোটি ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, দেশের স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বেসরকারি খাতেই সবচেয়ে বেশি। সরকারি খাতে এ ঋণের স্থিতি একেবারেই কম। এসব ঋণের বড় অংশই নেওয়া হয়েছে পণ্য আমদানির বিপরীতে। এ খাতে ঋণের সুদের হারও বেশি। ফলে বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ দেশের ডলার বাজার এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর বেশি চাপ সৃষ্টি করে। এছাড়া এসব ঋণ নিয়মিত পরিশোধ না করলে বা ঋণের কিস্তি পরিশোধ স্থগিত করলে এর বিপরীতে সুদের হার আরও বেড়ে যায়। পাশাপাশি দিতে হয় দণ্ড সুদ। যে কারণে এসব ঋণ দেশের রিজার্ভের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। এ ধরনের ঋণ অর্থনীতিতে ঝুঁকির মাত্রাও বাড়িয়ে দেয়। রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে অগ্রাধিকার দিয়েছে। কারণ, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়তে শুরু করেছে। পাশাপাশি রপ্তানি আয়ও বাড়ছে। এছাড়া বৈদেশিক অনুদান কমার প্রবণতাও হ্রাস পেয়ে এখন অনুদান বাড়তে শুরু করেছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। জ্বালানি তেলের দামও কমে এখন প্রতি ব্যারেল ৭০ ডলারের মধ্যে নেমে এসেছে। এর দাম আগামী দিনে আরও কমতে পারে। পণ্যের দাম ও জাহাজ ভাড়া কমায় দেশের আমদানি ব্যয়ও কমেছে। যে কারণে ডলারের খরচও কমেছে। অন্যদিকে আয় বেড়েছে। ফলে সব মিলে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বেড়েছে। এ কারণে চলতি ব্যয় মিটিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন আগের বকেয়া ঋণ পরিশোধ করার পাশাপাশি নিয়মিত ঋণের কিস্তিও সময়মতো পরিশোধ করছে। এ কারণে ঋণের স্থিতিও কমেছে। তবে সরকারি খাতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের স্থিতি কিছুটা বেড়েছে। এ খাতে ঋণ পরিশোধে জটিলতার কারণে স্থিতি বাড়ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বেড়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ১ হাজার ৬৪২ কোটি ডলারে উঠেছিল। বৈশ্বিক মন্দার কারণে সৃষ্ট ডলার সংকট মেটাতে ওই বছরে আমদানিতে সবচেয়ে বেশি স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিয়েছিল বেসরকারি খাত। এরপর থেকে ঋণ পরিশোধ যেমন বেড়েছে, তেমনই নতুন ঋণ নেওয়ার প্রবণতাও কমেছে। এতে ঋণের স্থিতি কমতে শুরু করেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয় ৫ আগস্ট। গত সরকার জুলাইয়ে ঋণের স্থিতি রেখে গিয়েছিল ১ হাজার ১৩২ কোটি ডলার। আগস্টে তা আরও কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ১২০ কোটি ডলার এবং সেপ্টেম্বরে ১ হাজার ৭৩ কোটি ডলারে নামে। অক্টোবরে তা আরও কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ৫২ কোটি ডলারে এবং নভেম্বরে তা আরও কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ১১ কোটি ডলারে। জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এ খাতে ঋণের স্থিতি কমেছে ১২১ কোটি ডলার বা প্রায় ১১ শতাংশ। তবে নভেম্বরে নিট হিসাবে ঋণের স্থিতি আরও কমেছে। এ স্থিতি হাজার কোটি ডলারের নিচে হবে।
আলোচ্য সময়ে আগের সরকারের আমলে বকেয়া বা স্থগিত করা বৈদেশিক ঋণের স্থিতিও কমতে শুরু করেছে। কারণ, এসব ঋণও কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিশোধ করছে। আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সরকার আগের স্থগিত করা স্বল্পমেয়াদি ঋণের মধ্যে ২০০ কোটি ডলারের বেশি পরিশোধ করেছে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি ঋণ শোধ করেছে প্রায় ৩০০ কোটি ডলার। দুই খাতে ৫০০ কোটি ডলারের বেশি পরিশোধ করা হয়েছে। এসব ঋণ পরিশোধ করতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে কোনো ডলার নিতে হয়নি। রিজার্ভে হাত দেওয়া ছাড়াই কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজস্ব উৎস থেকে বা ব্যাংকগুলো থেকে ডলার কিনে এসব ঋণ পরিশোধ করেছে। ফলে রিজার্ভ ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। আগে এশিয়ার ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দায় শোধ করার পর রিজার্ভ কমে গেলে আর ওই অবস্থানে যেত না। এ সরকারের আমলে দুই দফায় আকুর দেনা শোধ করা হয়েছে। পরে রিজার্ভ আবার আগের অবস্থানে ওঠে যাচ্ছে। বর্তমানে নিট রিজার্ভ ১ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের বেশি।
এদিকে বেসরকারি খাতে আমদানিতে স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার প্রবণতাও আগের চেয়ে কমেছে। তবে সরকারি খাতে ঋণের স্থিতি কিছুটা বেড়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে সরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ৭ হাজার ৯৮০ কোটি ডলার। গত অক্টোবরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৭২১ কোটি ডলার। মূলত সরকারি খাতে রাশিয়া থেকে নেওয়া ঋণ এখন বৈশ্বিক জটিলতার কারণে পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া আরও কিছু দেনা বকেয়া রয়েছে। এ কারণে এ খাতে ঋণের স্থিতি বাড়ছে। বর্তমানে দেশের মোট বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ১০ হাজার কোটি ডলার। এর মধ্যে সরকারি খাতের ঋণ ৮ হাজার কোটি ডলার। গত বছরের ডিসেম্বরে মোট ঋণের স্থিতি ছিল ১০ হাজার ৬৫ কোটি ডলার। এর মধ্যে সরকারি খাতের ঋণ ছিল ৭ হাজার ৯৬৯ কোটি ডলার। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতের ঋণ ২ হাজার ১০০ কোটি ডলার থেকে কমে ২ হাজার কোটি ডলারে নেমে এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে দেশে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বেড়েছে প্রায় সাড়ে ২৬ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছিল দশমিক ১৭ শতাংশ। একই সময়ে রপ্তানি আয় বেড়েছে সাড়ে ৮ শতাংশ। গত অর্থবছরের ওই সময়ে এ খাতে আয় কমেছিল। চলতি অর্থবছরের ওই সময়ে এলসি খোলা কমেছে ১ দশমিক ২২ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে কমেছিল প্রায় ৮ শতাংশ।
বৈদেশিক অনুদান কমছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বৈদেশিক অনুদান কমার প্রবণতা কমেছে। গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে অনুদান কমেছিল ৭০ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে কমেছে ১৩ শতাংশ।
বৈদেশিক মুদ্রার খরচের থেকে আয় বেশি বাড়ায় বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ কমতে শুরু করেছে। গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে এ খাতে ঘাটতি ছিল ৩১৬ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭৫ কোটি ডলারে।
বাজারে ডলারের প্রবাহ বাড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নতুন করে আর কোনো ঋণ স্থগিত করতে নিষেধ করেছে। এখন থেকে সব ঋণের কিস্তি নিয়মিত শোধ করতে বলেছে। কোনো কারণে ঋণের কিস্তি পরিশোধ দেরি হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে।