ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের গত সাড়ে ১৫ বছরে দেশের ব্যাংক খাতে ব্যাপক লুটপাটে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে এসেছে। লুটপাটের টাকার বড় অংশ বিদেশে পাচার করা হয়েছে। ওইসব টাকা এতদিন খেলাপি করা হয়নি। এখন সেগুলো খেলাপি হচ্ছে। আগে খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য আড়াল করে কমিয়ে দেখানো হতো। এখন সব তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ গতিতে বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণ।
এদিকে আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী মার্চের মধ্যে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আন্তর্জাতিকমানের করতে হবে। তখন থেকে কোনো ঋণের কিস্তি পরিশোধের মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার ৩ মাস পর থেকে খেলাপি হবে। এখন খেলাপি হচ্ছে ৬ মাস পর। ঋণখেলাপি হওয়ার সময় ৩ মাস এগিয়ে আনা হলে এর অঙ্ক আরও বেড়ে যাবে। এসব কারণে আগামীতে ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে ব্যাংক খাতে প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতি বেড়ে যাবে। এতে ব্যাংকগুলো আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। পাশাপাশি বৈদেশিক বাণিজ্যে বাড়তি ফি বা কমিশন দিতে হবে। ফলে ব্যবসা খরচ বাড়বে। এর প্রভাবে বাড়বে পণ্যের দাম। যা সরাসরি ভোক্তাকে আক্রান্ত করবে।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাতের লুটপাটের চিত্র প্রকাশ্যে আসতে থাকে। একই সঙ্গে বাড়তে থাকে খেলাপি ঋণের অঙ্ক। সরকার পতনের আগে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছরে ২৪টি বড় কেলেঙ্কারির ঘটনায় ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লুট করা হয়েছে। এর মধ্যে এস আলম গ্রুপ, নাসা গ্রুপ ও বেক্সিমকো গ্রুপের নাম ছিল না। এসব বড় শিল্প গ্রুপের নামেও এখন ভয়ানক জালিয়াতির তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, এখন পর্যন্ত ব্যাংক খাত থেকে ২ লাখ কোটি টাকা লুট করে পাচার করা হয়েছে। এর মধ্যে এস আলম গ্রুপ একাই পাচার করেছে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। এ অর্থের মধ্যে শুধু ইসলামী ব্যাংক দখল করে সেখান থেকেই পাচার করা হয়েছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। অন্যরা পাচার করেছেন ৮০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপ এক হাজার কোটি টাকা, নাসা গ্রুপ হাজার কোটি টাকার বেশি পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে। বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণের স্থিতি ৩৬ হাজার কোটি টাকা, নাসা গ্রুপের ঋণের স্থিতি ২১ হাজার কোটি টাকা। এসব ঋণ নেওয়া হয়েছে জালিয়াতির মাধ্যমে। এসব অর্থ এখন খেলাপি হচ্ছে।
বিগত সরকার মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ করেছিল। ওই সময়ে এস আলম, বেক্সিমকো, নাসা গ্রুপের কোনো খেলাপি ঋণ ছিল না। একই সঙ্গে দুর্নাম এড়াতে খেলাপি ঋণের তথ্যও গোপন করা হয়েছিল। তারপরও মার্চে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকায়। যা ছিল মোট ঋণের ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। এর আগে গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৯ শতাংশ। ডিসেম্বরের তুলনায় মার্চে খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ৩৭ হাজার কোটি টাকা।
৫ আগস্ট সরকারের পতন হলে জুন প্রান্তিকের খেলাপি ঋণের তথ্য ৪ সেপ্টেম্বর প্রকাশ করে বর্তমান সরকার। ওই সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকায়, যা মোট ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। ওই সময়ে জালিয়াতদের কোনো ঋণ নতুন করে খেলাপি করা হয়নি। শুধু খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করা হয়। এতেই খেলাপি ঋণ বেড়ে যায় ২৯ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরের মধ্যে জালিয়াতদের ঋণগুলোও খেলাপি হতে থাকে। এতে খেলাপির অঙ্ক বেড়ে যায়। সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকায়। যা মোট ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশ। ৩ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা।
নতুন সরকারের আমলে জুন ও সেপ্টেম্বরের খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। এতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা। বৃদ্ধির হার ৫৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ। অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় খেলাপি ঋণের এ বৃদ্ধি একটি সর্বোচ্চ রেকর্ড।
ব্যাংকারদের আশঙ্কা- ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের চিত্র আগামীতে আরও ভয়ংকর রূপ নিতে পারে। কারণ এস আলম গ্রুপের ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা পুরোটাই আগামীতে খেলাপি হবে। গত প্রান্তিকে তাদের ঋণের সামান্য অংশ খেলাপি করা হয়েছে। বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণের একটি অংশ খেলাপি করা হয়েছে। তাদের ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋণের পুরোটাই খেলাপি হতে পারে। কারণ তারা আগামী ১০ বছর ঋণ পরিশোধে অক্ষমতা প্রকাশ করেছে। নাসা গ্রুপের ঋণের একটি বড় অংশ আগামীতে খেলাপি হবে। তখন খেলাপি আরও বাড়বে। এছাড়া অন্যান্য ঋণ খেলাপি হতে পারে। এসব কারণে অনেকেই আশঙ্কা করছেন আগামী ডিসেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ৩ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। শতকরা হিসাবেও বাড়বে।
সূত্র জানায়, ব্যাংকগুলো এখনো কোনো ঋণকে খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে শিথিলভাবে বিবেচনা করছে। কিন্তু আগামী বছর থেকে বড় গ্রুপগুলোর ঋণ আরও বেশি মাত্রায় খেলাপি হবে। তখন খেলাপি বাড়তেই থাকবে। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত অনুযায়ী মার্চের মধ্যে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে হবে। তখন ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় উত্তীর্ণ হওয়ার ৩ মাস পর থেকে তা খেলাপি করতে হবে। এখন করা হচ্ছে ৬ মাস পর। ফলে ঋণ খেলাপিরা ৩ মাস বাড়তি সময় পাচ্ছে। এটি না পেলে খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে যাবে। ফলে খেলাপি ঋণের আকাশচুম্বী ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ব্যাংক খাতের জন্য বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বাড়লে প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে যাবে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫৬ হাজার কোটি টাকা। আগামীতে এ ঘাটতি আরও বেড়ে যাবে। পাশাপাশি বাড়বে মূলধন ঘাটতি। এতে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বেড়ে যাবে। মুনাফা থেকে তখন প্রভিশন রাখতে হবে। শেয়ারহোল্ডাররা লভ্যাংশ কম পাবেন। একই মুনাফা কম পাবেন আমানতকারীরা।
আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাংকগুলো বৈদেশিক ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। বেশিরভাগ ব্যবসাই হয় বাকিতে বা ঋণ নির্ভর। এ কারণে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাংকগুলোর সব ধরনের খবরাখবর রাখা হয়। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ, প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা যায়। এসব সূচকে ব্যাংকের অবনতি হলে বৈশ্বিকভাবে ব্যাংকগুলো সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের এলসি গ্রহণ করতে চায় না। তখন তৃতীয় কোনো ব্যাংকের গ্যারান্টি দিতে হয়। এতে ওই ব্যাংককে গ্যারান্টি ফি হিসাবে দশমিক ৪০ থেকে দশমিক ৬০ শতাংশ পর্যন্ত গ্যারান্টি দিতে হয়। এ অর্থ পরিশোধ করতে হয় গ্রাহককে। ফলে আমদানি খরচ বেড়ে যায়। এর প্রভাবে বৃদ্ধি পায় পণ্যের দাম। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ভোক্তার ওপর। এজন্য ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক ও উদ্যোক্তারা।
বর্তমানে ডলার স্বল্পতার কারণে বেসরকারি ব্যাংকগুলো এলসি করছে কম। সরকারি ব্যাংকগুলোই বেশি এলসি করছে। অথচ সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার সেপ্টেম্বরে ৪০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। আগামীতে এ হার আরও বাড়বে। তখন সরকারি ব্যাংকগুলোতে সংকট আরও ঘনীভূত হবে। শুধু খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণে সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে অস্বস্তির মাত্রাও বেড়ে যাবে। এ কারণে খেলাপি ঋণের বৃদ্ধি অন্য সব সূচককে নেতিবাচক ধারায় নিয়ে যাবে।
নতুন সরকার বেশ কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে ব্যাংক খাত থেকে লুটপাট ও অর্থ পাচার বন্ধ হয়েছে। এতে বাজারে ডলারের প্রবাহ বেড়েছে। তারল্যও বাড়তে শুরু করেছে। ব্যাংক থেকে তুলে নেওয়া অর্থাৎ ফেরত আসতে শুরু করেছে। তবে নয়টি দুর্বল ব্যাংকে তারল্য সংকট এখনও প্রকট।