চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ২০১৭ সালের ১৫ মার্চ সাজানো অপারেশন চালিয়ে একটি পরিবারের পাঁচজনকে হত্যা করা হয় জঙ্গি সাজিয়ে। সেই সময় দেশব্যাপী জঙ্গি সাজিয়ে আটক করার মৌসুম চলছিল। আজ এখানে তো কাল ওখানে, প্রথমে জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে একটি স্থাপনা ঘিরে রাখে পুলিশ। দীর্ঘ সময় হুমকি-ধমকি, গুলি-পাল্টাগুলি ছোড়ার পর বাড়ির ভেতর থেকে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে কয়েকজনের মৃত্যু। কথিত জঙ্গি অভিযানের সেই আত্মঘাতী হামলায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শুধু জঙ্গিরাই মারা যায়। কয়েকজন পুলিশ আহত হয়েছে দাবি করা হলেও তাদের নাম প্রকাশ করা হতো না।
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের পাবলিক রিলেশন দপ্তর থেকে জানানো হয় জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে সীতাকুণ্ডের একটি বাড়ি ঘিরে রেখেছে পুলিশ। চৌধুরীপাড়ার ছায়ানীড় বাড়ির সন্ধানে ছোটে গণমাধ্যমকর্মীরা। কিন্তু তাদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। জানানো হয়, বাড়িতে বোমার মজুত নিয়ে অপেক্ষা করছে জঙ্গিরা। যে কোনো সময় ঘটতে পারে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। এমন প্রচার চালিয়ে আশপাশের বাসিন্দাদেরও সরিয়ে নেয় তারা। হ্যান্ড মাইকে বাড়িতে অবস্থান করা কথিত জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানাতে থাকে। ফাঁকা গুলি করতে থাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। রাতে বহু পুলিশ ও র্যাব সদস্য জড়ো হয়। কালো গ্লাসে ঢাকা প্রায় অর্ধশত মাইক্রো ও জিপ গাড়ির সন্দেহজনক চলাচলও বাড়ে। পরদিন সকালে ওই ভবনের দ্বিতীয় তলার সিঁড়িঘরের ভেতরে ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। এতে নারী শিশুসহ নিহত হন পাঁচজন। সবাইকে অজ্ঞাত হিসেবে দাফন করা হলেও পরে পরিচয় উদঘাটন হয় তিনজনের। তারা হলেন বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার মোজাফফর আহমেদের ছেলে কামাল হোসেন, তার স্ত্রী জোবাইদা বেগম ও তাদের ছয় মাস বয়সি সন্তান সৃজন। নিহত বাকি দুজনের নাম রাশেদ ও হৃদয় বলে মামলায় উল্লেখ থাকলেও বিস্তারিত ঠিকানা কোথাও নেই।
প্রত্যক্ষদর্শী সীতাকুণ্ড প্রেস ক্লাবের আহ্বায়ক জহিরুল ইসলাম জানান, একই দিন আরেকটি জায়গায় অভিযান চালানো হয়। প্রথমে অভিযান চালানো হয় ছায়ানীড় ভবন থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে আমীরাবাদ এলাকার সাধন কুটিরে। শিশুসহ স্বামী-স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয় জঙ্গি সন্দেহে। গ্রেপ্তারদের থানায় নেওয়ার আগেই ঘিরে ফেলা হয় ছায়ানীড় ভবন। ১০ থেকে ১৫ মিনিটের ব্যবধানে দুটি অভিযান পরিচালিত হয়। সাধন কুটির থেকে সিএনজি অটোরিকশায় ছায়ানীড় ভবনে আসতে তার সময় লাগে ১০ থেকে ১২ মিনিট। কিন্তু সেখানে এসেই দেখতে পান সীতাকুণ্ড থানা পুলিশের সঙ্গে অভিযানে অংশ নিয়েছেন চট্টগ্রাম পুলিশ লাইন থেকে আসা বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য। চট্টগ্রাম থেকে রাস্তায় জ্যাম না থাকলেও সীতাকুণ্ড কলেজের পাশে কথিত ওই জঙ্গি আস্তানায় আসতে এক ঘণ্টার কাছাকাছি সময় লাগবে। অথচ আধাঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে তৎকালীন এসপি নুরে আলম মীনার নেতৃত্বে জেলা পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সবাই হাজির হন সেখানে।
এক ঘণ্টার কিছু বেশি সময়ের মধ্যে অভিযানে যুক্ত হয় র্যাবসহ গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা। এত অল্প সময়ের মধ্যে চট্টগ্রাম থেকে শীর্ষ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছে যাওয়ায় বিস্মিত হন গণমাধ্যমকর্মীরা। যদিও ওই অভিযান নিয়ে সন্দেহ বা প্রশ্ন তোলার মতো সাহস ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত কারোই ছিল না।
গলির মাথায় দাঁড়িয়ে থেকে পুলিশের কথিত অভিযান পর্যবেক্ষণ করেন সীতাকুণ্ড, ফেনী ও চট্টগ্রাম থেকে আসা গণমাধ্যমকর্মীরা। কথিত নিরাপত্তা বেষ্টনীর নামে অনেক দূর থেকে রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হলেও কালো গ্লাসের গাড়িগুলো যাতায়াত করেছে হরহামেশা। কথিত ওই অভিযানের পোশাকি নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন অ্যাসল্ট সিক্সটিন’। পরদিন ভোর ৬টা থেকে সোয়া ৬টার মধ্যে বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শোনেন জহিরুল ইসলাম।
এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সেখানে অবস্থান করা গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, পুলিশ ও সোয়াতের সদস্যরা পাশের একটি ভবন থেকে ছায়ানীড় ভবনের ছাদে প্রবেশ করলে জঙ্গিরা আর নিজেদের রক্ষা করতে পারবে না এমন আশঙ্কা থেকেই আত্মঘাতী বোমা ফাটিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
ছায়ানীড় ভবনের সামনের মুদি দোকানদার মাহবুবুল করিম জানান, ঘটনার আনুমানিক দুই মাস আগে ছায়ানীড় ভবনের নিচতলার একটি ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া নেয় একটি পরিবার। হালকা-পাতলা গড়নের ২৫-২৬ বছরের এক যুবক, তার স্ত্রী আর আনুমানিক ছয় মাস বয়সি তাদের সন্তান থাকত সেখানে। তার দোকান থেকে মাঝে মধ্যে বাজারও করতেন তারা। ঘটনার দিন দুপুরের দিকে হঠাৎ করে কিছু পুলিশ এসে পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে। পরদিন ভোরে বোমা বিস্ফোরণের পর পুলিশ জানায়, আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে তারা নিহত হন। সকাল ৭টার পর দোকানের সামনে আসেন তিনি। এ সময় পাশের একটি গর্তে একটি পুরুষের শরীরের নিচের অংশ পড়ে থাকতে দেখেন। কিন্তু ওই বাড়িতে যে পরিবারটি ভাড়া থাকত ওই পুরুষের শরীরের সঙ্গে কোনো মিল দেখেননি। একই কথা জানান সেখানকার বাসিন্দা কৃষক আজাদ চৌধুরী। তার দাবি ছায়ানীড় ভবনে ভাড়া থাকা মানুষদের সঙ্গে বোমা বিস্ফোরণে নিহতদের শরীরের কোনো মিল ছিল না। রাতে কালো গ্লাসে ঘেরা যেসব গাড়ি ওখানে এসেছে সেই গাড়িগুলোর কোনো একটিতে নিহত লোকদের নিয়ে এসে বাড়িতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, বিপরীতে বাড়িতে থাকা পরিবারটিকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এমন গল্প বেশ কিছু দিন চালু ছিল এলাকায়। কিন্তু প্রকাশ্যে এসব নিয়ে কেউ কিছু বলতে পারেনি।
ছায়ানীড় ভবনের মালিক মৃত অলিউল্লাহর স্ত্রী রেহানা বেগম জানান, তার বাড়িতে মোট সাতটি পরিবার ভাড়া থাকতেন। ঘটনার দিন দুপুর বেলা কয়েকজন পুলিশ জানতে চান দুই মাস আগে নতুন আসা পরিবারটি কোন ফ্ল্যাটে থাকে। তিনি দেখিয়ে দিলে পুলিশ দরজা ধাক্কাতে থাকে। হঠাৎ করেই ছোট একটা বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পান। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ সদস্যরা চিৎকার করতে করতে বাড়ির বাইরের দিকে দৌড় দেন। এরপর তিনিও ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেন। জানালা দিয়ে তিনি বাইরের দিকে দেখেন কয়েকশ পুলিশ তার বাড়ি ঘিরে ফেলেছে। বাড়িতে জঙ্গি আছে দাবি করে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানায় হ্যান্ড মাইকে। কিন্তু নিচতলার ভাড়া বাসা থেকে কোনো শব্দ তিনি শুনতে পাননি। বিকালে একজন পুলিশ তাকে বেরিয়ে আসতে বলেন। তিনি বোরকা পরে বের হয়ে আসার চেষ্টা করলে তাকে লক্ষ্য করে এক পুলিশ গুলি ছোড়ে। এ সময় অন্য পুলিশ সদস্যরা তাকে ফের ঘরে ফিরে যেতে বলেন। এরপর তিনি আবার দ্বিতীয় তলায় উঠে যান।
পরদিন ভোরে তিনি যে ফ্লাটে থাকতেন তার সামনেই বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শোনেন। বিস্ফোরণে তার বাড়ির সিঁড়িঘরের একাংশ ধসে পড়ে। এরও প্রায় এক ঘণ্টা পর পুলিশ এসে দরজা নক করলে তিনি দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন। এ সময় পুরো সিঁড়িঘর থেকে ছাদ পর্যন্ত রক্তাক্ত ও ছোট ছোট মাংসের টুকরা দেখতে পান। পুলিশ সদস্যরা তাকে একটি গাড়িতে করে সীতাকুণ্ড থানায় নিয়ে যান। এ সময় পাঁচটি লাশের ছিন্ন-ভিন্ন অংশ তিনি দেখতে পান। কিন্তু তার বাড়িতে ভাড়ায় থাকত তিনজন। শিশুটির লাশ দেখে বিস্মিত হন তিনি। কারণ যে পরিবার তার কাছ থেকে বাসা ভাড়া নিয়েছিল তাদের সঙ্গে যে বাচ্চাটি ছিল সেটি ছেলে শিশু। কিন্তু নিহত শিশুটি ছিল মেয়ে। লাশের সংখ্যা আর ছেলে শিশু মেয়ে হয়ে যাওয়া নিয়ে সীতাকুণ্ড থানার ওসিকে প্রশ্ন করেছিলেন তিনি। ওসি তাকে জানিয়েছিলেন সাধন কুটিরে ধরা পড়া জঙ্গি আর তার বাড়িতে ধরা পড়া জঙ্গিরা একই দলের সদস্য। হয়তো কোনো রাতের আঁধারে দুটি পরিবার নিজেদের বাসা অদল-বদল করে নিয়েছে। উত্তরটি তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য না হলেও পাল্টা প্রশ্ন করার সাহস তার ছিল না।
পরদিন পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সাধন কুটির থেকে গ্রেপ্তার হওয়া জহিরুল হক ও তার স্ত্রী আরজিনার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ছায়ানীড় বাড়ির সন্ধান পান তারা। কিন্তু অভিযান পর্যবেক্ষণকারী সীতাকুণ্ডের অন্তত তিনজন সাংবাদিক জানান, দুটি অপারেশন সর্বোচ্চ ১০ মিনিটের ব্যবধানে পরিচালিত হয়েছে। সাধারণ কোনো অপরাধীও এত অল্প সময়ে সহযোগীদের ঠিকানা প্রকাশ করবে কি না সন্দেহ রয়েছে। লাশগুলোর পরিচয় তখন জানানো হয়নি। অজ্ঞাত হিসেবেই দাফন করা হয় তাদের।
সাধন কুটির থেকে গ্রেপ্তার করা হয় জহুরুল হক ও তার স্ত্রী রাজিয়া সুলতানাকে। মামলার এজাহারে পুলিশ দাবি করে জহুরুল হকের নাম জসিম উদ্দিন আর আরজিনা হকের নাম রাজিয়া সুলতানা। তারা সবাই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবির সদস্য। জহুরুল আর আরজিনা তাদের সংগঠনের দেওয়া ছদ্ম নাম। কিন্তু এলাকায় তারা জহুরুল আর আরজিনা নামেই পরিচিত। ছায়ানীড় বাড়িতে কথিত আত্মঘাতী হামলায় নিহতের ঘটনায় হওয়া মামলায়ও তাদের আসামি করে পুলিশ। এ ছাড়া সিলেটের আতিয়া মহলে জঙ্গি হামলা, নাইক্ষ্যংছড়িতে বৌদ্ধ ভান্তে হত্যাসহ মোট আটটি মামলায় অভিযুক্ত করা হয় তাদেরকে। টানা আট বছর জেল খেটে সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছেন জহুরুলের স্ত্রী আরজিনা হক ও তার শিশু সন্তান মোহাম্মদ জোবায়ের। ছয় মাস বয়সে মায়ের সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়ে টানা আট বছর চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারেই কেটেছে তার শৈশব। নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারী এলাকার শ্বশুরবাড়িতেই সন্তানকে নিয়ে বসবাস করেন তিনি। গত ২০ মার্চ দুপুরে সেখানেই কথা হয় আর্জিনা ও জহুরুলের পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে।
তার বড় ভাই জিয়াবুল হক জানান, বাইশারি বাজারে একটি পানের দোকান চালাতেন জহুরুল। একপর্যায়ে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশে গ্রাম ছাড়ে তার ভাই। সঙ্গে তার বোন জোবাইদা বেগম তার স্বামী কামাল হোসেন ও তাদের ছয় মাসের সন্তান সৃজনকে নিয়ে জহুরুলের সঙ্গে চট্টগ্রামে যান উন্নত জীবনের আশায়। ঝগড়া বিবাদ করে বাড়ি ছাড়ায় তাদের সঙ্গে খুব একটা যোগাযোগ ছিল না তাদের।
২০১৭ সালের ১৭ মার্চ বাইশারী পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের এসআই মুসা ও এএসআই সোলাইমান এসে জানান, জিয়াবুল ও তার বাবাকে তাদের সঙ্গে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে যেতে হবে। কারণ জহুরুল জঙ্গি হিসেবে চট্টগ্রামে ধরা পড়েছে। বাবাকে নিয়ে পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে গিয়ে দেখেন, সেখানে আগে থেকেই তার বোনের শ্বশুর অর্থাৎ কামালের বাবা মোজাফফর আহমেদ অপেক্ষা করছেন।
তিনজন পুলিশের সঙ্গে তারা তিনজন মিলে ছয়জন সীতাকুণ্ডের উদ্দেশে রওনা হন। সীতাকুণ্ড থানার দ্বিতীয় তলার একটি রুমে চার দিন রাখা হয় তাদের। এই সময়ের মধ্যে দুবার জহুরুল ও আর্জিনার সঙ্গে তাদের দেখা হয়। দুজনেরই চোখ বাঁধা ছিল কালো কাপড় দিয়ে। তার বোন জোবাইদা, বোনের জামাই কামাল ও তাদের সন্তান ছায়ানীড় ভবনে বোমা হামলায় নিহত হয়েছে তা তখনো জানতে পারেননি তারা। ছয় মাস পর জানানো হয় তাদের নিহত হওয়ার কথা। লাশ নিতে ছুটে যান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে। কিন্তু জানানো হয় বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করে ফেলা হয়েছে।
জহুরুলের স্ত্রী আরজিনা হক জানান, তার ননদ ও ননদের পরিবার একসঙ্গে চট্টগ্রামে গেলেও সেখানে তাদের সঙ্গে দেখা হয়নি কখনো। সীতাকুণ্ডের একটি বাড়িতে ভাড়ায় থাকতেন তারা। কিন্তু সেটি সাধন কুটির কি না, তা তার জানা নেই। একদিন সাদা পোশাকের পুলিশ তাকে ও তার স্বামীকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ সদস্যরা তাকে বলে ‘তোমাদের সহযোগীদের একটি বাড়িতে বোমা মেরে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু পুলিশের কথা তিনি বুঝে উঠতে পারেননি তখন। টানা তিন মাস তাদের আটকে রাখে পুলিশ। পরে জানতে পারেন তাদের থানায় আটকে রেখেই আদালতে শুধু কাগজ পাঠিয়ে চার দফায় ৫৯ দিন রিমান্ড মঞ্জুর করিয়ে নেয় পুলিশ। রিমান্ডে থাকাকালে প্রতি রাতে তাদের ওপর চালানো হতো অমানুষিক নির্যাতন। রাতে আদালতে কি কি বলতে হবে তার স্ক্রিপ্ট মুখস্থ করানো হতো তাদের। একটু ভুল করলেই পেটাত পুলিশ। পুলিশি নির্যাতনে তার দুই মাসের গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে যায়। দুই মাসের বেশি সময়ে বহুবার তার পেঁচানো কাপড়ের বেল্ট (সুইসাডল ভেস্ট) পরিয়ে বাচ্চা কোলে নিয়ে পুলিশের কথা মতো অভিনয় করতে হয়েছে তাকে। এসব আবার পুলিশ সদস্যরা ক্যামেরা ও মোবাইলে ভিডিও করত নিয়মিত।
৫৯ দিন রিমান্ডের পর চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয় তাদের। সেখান থেকেই জানতে পারেন সিলেটের আতিয়া মহল ও বাইশারীতে বৌদ্ধ ভান্তে হত্যাসহ অন্তত আটটি মামলা দেওয়া হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। কারাগার থেকেই কখনো ঢাকায় কখনো সিলেটে নিয়ে যাওয়া হতো তাদের। বয়স কম হওয়ায় তার সন্তানকে তার সঙ্গে রাখা হয়। আট বছর পর গত জানুয়ারি মাসে তিনি মুক্তি পেলেও তার স্বামী এখনো কারাগারে। সব মামলায় জামিন হলেও এখনো তাকে ছাড়া হয়নি অজ্ঞাত কারণে।
পাঁচজন নিহত হওয়ার মতো এত বড় বিস্ফোরণের ঘটনার মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে ঘটনাস্থল থেকে ১০টি তাজা গ্রেনেড, ৩টি সুইসাইডেল বেল্ট উদ্ধার করে নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। কিন্তু মামলার মূল অভিযোগপত্রে এসবের কিছুই উল্লেখ নেই।
২০১৭ সালের ২৪ মার্চ সিলেটের আলোচিত আতিয়া মহলে এমন একটি জঙ্গি নাটক সাজায় প্রশাসন। ওই মামলায়ও আসামি করা হয় জহুরুল হক, তার স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা আরজিনা ও হাসান বশরী নামের আরেক যুবককে। এই হাসান বশরীর বাড়িও নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারীতে। আতিয়া মহলের মামলায় পুলিশ উল্লেখ করে, বাসে করে ঢাকায় বোমা নিয়ে যাওয়ার সময় কুমিল্লা থেকে আটক হন হাসান বশরী। তিনিও নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবির সদস্য। তার কাছ থেকে তথ্য পেয়ে সীতাকুণ্ডের সাধন কুঠিরে অভিযান চালিয়ে জহুরুল আর আরজিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের স্বীকারোক্তি মোতাবেক ওই দিনই সীতাকুণ্ডের ছায়ানীড় ভবনে অভিযান চালানো হয়। পরে ওই মামলায় রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে জহুরুল আর আরজিনার কাছেই আতিয়া মহলের তথ্য পায় পুলিশ। অথচ ছায়ানীড় সংক্রান্ত মামলায় উল্লেখ করা হয় সাধন কুঠিরের মালিক সুভাষ দাশ পুলিশকে তার ভাড়াটিয়ার সন্দেহজনক আচরণ ও ঘরের মধ্যে ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস আর বিভিন্ন ধরনের সার্কিট নিয়ে কাজ করার তথ্য দেয়। বাড়ির মালিকের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
হাসান বশরীর বক্তব্য
সাধন কুটির, ছায়ানীড়, আতিয়া মহলসহ ৯টি জঙ্গি মামলায় জহুরুল হক ও আরজিনা বেগমের সঙ্গে অভিযুক্ত করা হয় হাসান বশরীকেও। যদিও আতিয়া মহলসহ চারটি মামলায় তাদের ফ্যাসিস্ট আমলেই বেকসুর খালাস দিয়েছে আদালত। তিনি জানান, আট বছর জেল খেটে হালে জামিনে বেরিয়েছেন তিনি। সন্দেহের অজুহাতে পুলিশ তাকে গাড়িতে তুলে কুমিল্লা থানায় নিয়ে যায়। সেখানেই একটি মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার দেখানো হয় তাকে। ৫ আগস্টের পর জামিনে মুক্তি পেলেও এখনো পাঁচটি মিথ্যা মামলার ঘানি টানতে হচ্ছে তাকে।
বিপিএম পদকে ভূষিত করা হয় এসপি মিনাকে
২০১৮ সালে বিপিএম পদকে ভূষিত হন তখনকার এসপি নুরে আলম মিনা। সে সময় পদক পাওয়ার কারণ হিসেবে দেখানো হয় অপারেশন অ্যাসল্ট সিক্সটিনকে। জঙ্গিবিরোধী অভিযানের নামে পাঁচজনকে খুন করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের জঙ্গি ন্যারেটিভকে প্রতিষ্ঠিত করার পুরস্কার হিসেবে ওই পদক দেওয়া হয় এসপি মিনাকে।
পুলিশের বক্তব্য
তৎকালীন পুলিশ সুপার নুরে আলম মীনা অল্প দিনের ব্যবধানে পদোন্নতি পেয়ে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজিও হন। ৫ আগস্টের পর তাকে সারদা পুলিশ একাডেমিতে সংযুক্ত করা হয়। তার বক্তব্য জানার জন্য ফোন করা হলেও রিসিভ করেননি। ওই সময় সীতাকুণ্ড থানার ওসি ইফতেখার হাসান ও মামলার বাদী ওসি তদন্ত মোজাম্মেল হককে একাধিকবার ফোন করলেও ফোন ধরেননি। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মাহবুব মিলকি জানান, অনেক দিন আগের ঘটনা হওয়ায় পুরোটা তার মনে নেই। তবে এই ঘটনা সাজানো নয়। যতটুকু মনে পড়ে একটি সংঘবদ্ধ চক্র দেশের বিভিন্ন এলাকায় জঙ্গি কার্যক্রম চালাচ্ছিল। তাদেরই একটি অংশকে গ্রেপ্তার করা হয় ও গ্রেপ্তারের সময় আত্মঘাতী বোমা হামলায় হতাহতের ঘটনা ঘটে। আদালত থেকে সিলেটের আতিয়া মহলসহ বেশ কয়েকটি মামলায় অভিযুক্তরা খালাস পেয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি জানান, আদালত যা ভালো মনে করেছে তাই করেছে এ ব্যাপারে তার কোনো মন্তব্য নেই। একাধিক মামলার অসংগতি ও স্থানীয়দের বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, অনেক দিন আগের ঘটনা হওয়ায় এসবের কিছুই মনে নেই তার।
মানবাধিকার কর্মীর বক্তব্য
অন্তর্বর্তী সরকারের গুম-সংক্রান্ত কমিশনের সদস্য মানবাধিকারকর্মী নুর খান লিটন জানান, পতিত সরকার আমলের একটি নির্দিষ্ট সময় নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় জঙ্গি দমনের নামে নাটক করা হয়েছে। সবগুলো ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়। ঘটনাগুলো সব একই প্যাটার্নে সংঘটিত হয়েছে। আবার প্রতিটি ঘটনায় সংশ্লিষ্ট পুলিশ কিংবা র্যাব সদস্যদের পদোন্নতি ও নানা পদকে ভূষিত করা হয়েছে। এতে রাষ্ট্রীয় মদদে মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটেছে। প্রতিটি ঘটনায় দরিদ্র ও পরিবার থেকে আলাদা এমন মানুষদের টার্গেট করে হত্যা করা হয়েছে বিনা বিচারে। এর চেয়ে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা আর হতে পারে না।