ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন শেখ হাসিনা। এর পর গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। পাহাড় সমান প্রত্যাশা নিয়ে যাত্রা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের। এক মাস পার করল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের ১ মাসে কতটুকু অগ্রগতি ও প্রাপ্তি হয়েছে এ বিষয়ে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
দুর্নীতি-অনিয়ম ও দলীয়করণের মাধ্যমে প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগ, অর্থনীতি থেকে শিক্ষা-সব ক্ষেত্রে যে কঙ্কাল রেখে গেছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার- তার সমাধান স্বল্প সময়ে কঠিন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা জিল্লুর রহমান বলেন, ‘আমরা সুশাসনের সম্পূর্ণ ধসে আক্রান্ত হয়েছিলাম। ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার আক্রান্ত হয়েছিলাম। সেক্ষেত্রে সংস্কার শব্দটি একমাত্রিক করলে চলবে না। রাজনৈতিক দল, রাষ্ট্রযন্ত্র এবং যারা ক্ষমতায় থাকবেন, তারা ক্ষমতা কীভাবে ব্যবহার করছেন, সেটার-ও সংস্কার দরকার।
রাজনৈতিক গবেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘আমরা যে ধরনের রাজনীতিতে অভ্যস্ত, এজন্য-ই তিন মাস, ছয় মাস, দশ বছর কথাগুলো আসছে। আর কিছু কিছু লোকজন-তো পাগল হয়ে গেছেন ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। রামের বদলে রহিম সংসদ ভবনে যাবে। এইযে ৩৫০ জনের যে মালিক সমিত, তার সদস্য হবে। কিন্তু এতে আমার লাভ কি, আপনার লাভ কি? তো সেজন্য-ই সংস্কারটা দরকার।’
তবে কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র সংস্কারের রোডম্যাপ দ্রুতই নির্ধারণ করা জরুরি বলে মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। কেননা এরইমধ্যে নানা পক্ষ নিজেদের ক্ষমতাবান মনে করে সুযোগ নিতে শুরু করেছে।
মহিউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, অনেকগুলো পাওয়ার সেন্টার রয়েছে। যেমন, আমলাতন্ত্র একটা পাওয়ার সেন্টার। কিছু রাজনৈতিক দল আছে, সেগুলো পাওয়ার সেন্টার। এরপর ছাত্ররা একটা পাওয়ার সেন্টার। সেনাবাহিনী একটা পাওয়ার সেন্টার। সুতরাং পরিস্থিতি অস্থির।
এদিকে, এমন পরিস্থিতি অস্থির নিয়ে জিল্লুর রহমান বলেছেন, বিভিন্ন জন অ্যাক্টিভ রয়েছেন। প্রত্যেকের প্রয়োজনগুলো মেটাবার প্রয়োজন রয়েছে। তাই, এগুলো সুষ্ঠুভাবে একটা সার্বিক পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। এমন নয় যে প্রতিযোগিতামূলক ক্ষমতার কেন্দ্র অনেকগুলো হলো। এটাতো এক ধরনের বিশৃঙ্খলার দিক হয়।
অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রকাশে এরইমধ্যে কমিটি গঠন করেছে সরকার। তবে বাজার নিয়ন্ত্রণসহ অর্থনীতিতে আস্থা ফেরাতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ সাবেক তত্ত্ববধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুরের। গুরুত্ব দিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি জোরদারের ওপর-ও।
হোসেন জিল্লুর বলছেন, গণহত্যা-গুম, খুন-দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগের দ্রুত তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করে দৃষ্টান্ত স্থাপন সৃষ্টি করতে হবে। ঢালাও মামলা যেন এসব কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে।
আক্রোশ ও বিভাজনের রাজনীতি থেকে দূরে থাকার পরামর্শও বিশ্লেষকদের। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকে আরো সহনশীল হয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতার অনুরোধ তাদের।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেওয়া বিভিন্ন আইনি সুবিধা এবং মামলার রায় নতুন করে পর্যালোচনা হচ্ছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হচ্ছে, তার পরিবারের সদস্যদেরও মামলা করা হচ্ছে।
বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। তাদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে হামলা হয়েছে এবং শেখ হাসিনাসহ আগের সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের লাল পাসপোর্ট বাতিল করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুম হওয়া ব্যক্তিদের খোঁজ মিলছে এবং গুমের ঘটনা তদন্তের জন্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। সরকার গুমবিষয়ক আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে। দুর্নীতি দমন এবং ব্যাংকিং খাতের সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতের জন্য একটি আলাদা কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এছাড়া, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা ও উপজেলা মেয়র ও চেয়ারম্যানদের অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদে কিছুটা নমনীয়তা দেখানো হয়েছে, যেখানে প্যানেল চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব পালন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এবিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এক মাসের মধ্যে সরকারের কাজের যথাযথ মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়, তবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হবে।
সূত্রঃ যুগান্তর