রবিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৫:৫৭ অপরাহ্ন

মানবতার বীরশ্রেষ্ঠ শিক্ষক মাহেরিন

  • সময়: বুধবার, ২৩ জুলাই, ২০২৫, ১১.০০ এএম
  • ৮১ জন

মানবতার বীরশ্রেষ্ঠ এক শিক্ষক মাহেরিন চৌধুরী। নিজে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে বাঁচিয়ে গেছেন স্কুলের সন্তানতুল্য কচি কচি শিশুকে। মায়ের মতো মমতা ও শিক্ষকের দায়িত্বশীলতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তিনি।

রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ভয়াবহ ঘটনায় যখন সবাই প্রাণ রক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিলেন, ঠিক তখন নিজের মৃত্যুঝুঁকি উপেক্ষা করে নিষ্পাপ শিশু শিক্ষার্থীদের আগুনের ভেতর থেকে বের করায় ব্যস্ত ছিলেন তিনি। তার প্রচেষ্টায় অন্তত ২০টি শিশু সেখান থেকে উদ্ধার হলেও ততক্ষণে নিজে প্রায় শতভাগ দগ্ধ হন। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসার একপর্যায়ে চলে যান দুনিয়া ছেড়ে। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষকের সুমহান দায়িত্ব, কর্তব্যবোধ ও আত্মত্যাগের অনন্য নজির সৃষ্টি করলেন তিনি।

উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে গিয়ে সহকর্মী, ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের কাছ থেকে শিক্ষক মাহেরিনের মহত্বের বিভিন্ন কথা জানতে পারি। এ ঘটনা এখন দেশব্যাপী আলোচিত।

সহকর্মীরা জানান, স্কুলটির তিনটি শ্রেণির কো-অর্ডিনেটর হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন সিনিয়র শিক্ষক মাহেরিন চৌধুরী। প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় ১৭ বছর ধরে সুনামের সঙ্গে কর্মরত ছিলেন ৪৫ বছর বয়সি মমতাময়ী এই শিক্ষক। দীর্ঘ এ সময়ে তার দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও সততায় মুগ্ধ শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। সবার কাছে তিনি ছিলেন একজন দায়িত্বশীল ও অত্যন্ত আপনজন। তার প্রতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যেমন আস্থা ছিল, তেমনি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছেও ছিলেন খুব প্রিয়।

মানবতার নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী এই সহকর্মী সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানটির স্কুল শাখার প্রধান খাদিজা আক্তার বলেন, তিনি অবশ্যই একজন মানবিক মানুষ ছিলেন। তার ত্যাগ ও দায়িত্বশীলতা ছিল অতুলনীয়। স্কুলে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় তিনি নিজের জীবনের চেয়ে বাচ্চাদের অগ্রাধিকার দিয়ে আগুন থেকে বের করেছেন। তিনি বলেন, মাহেরিন চৌধুরী ছিলেন খুব পেশাদার এবং ভালোমনের একজন মানুষ। জীবনবাজি রেখে তার এই দায়িত্বশীলতা আমরা চিরদিন মনে রাখব।

গত সোমবার দুপুরে বিমান বিধ্বস্ত-পরবর্তী পরিস্থিতি এবং মাহেরিন চৌধুরীর ভূমিকা সম্পর্কে তার সহকর্মী সিনিয়র শিক্ষক শেখ ফরিদ মঙ্গলবার বিধ্বস্ত ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আমার দেশকে বলেন, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির কো-অর্ডিনেটর ছিলেন মাহেরিন চৌধুরী। দুপুর ১টায় ছুটির পর তার দায়িত্ব অনুযায়ী বাচ্চাদের ক্লাস থেকে বের করে অভিভাবকদের হাতে তুলে দিচ্ছিলেন। অনেক বাচ্চার অভিভাবকের অপেক্ষায় তাদের সঙ্গে ক্লাসরুমে ছিলেন মাহেরিন। ১টা ১০ মিনিটের দিকে আমরা কয়েকজন টিচার্স রুমে খেতে বসেছিলাম। কয়েক মিনিটের মাথায় বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা ঘটে। আমরা দৌড়ে বের হয়ে আসি।

তিনি আরো বলেন, এ সময় বেশ কয়েকজন শিক্ষক ও বহু শিক্ষার্থী অগ্নিদগ্ধ হয়। মাহেরিনও অগ্নিদগ্ধ হন। কিন্তু তিনি ওই অবস্থায় নিজে সেখান থেকে বের না হয়ে এসে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রচণ্ড ধোঁয়া ও আগুনে আটকা পড়া বাচ্চাদের একের পর এক উদ্ধার করছিলেন। একপর্যায়ে তার গায়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। দগ্ধ অবস্থায় উদ্ধারকারীরা তাকে একটি ভ্যানে করে হাসপাতালে পাঠান। পরে রাতে আমরা তার মৃত্যুর খবর পাই।

সূত্রমতে, সোমবার রাত ১০টার দিকে ঢাকার জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে লাইফ সাপোর্টে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তিনি উত্তরা ১ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর রোডের ১০ নম্বর বাসার বাসিন্দা ছিলেন। গতকাল সকালে সেখানে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

গতকালও বিধ্বস্ত স্কুল ভবন দেখতে ভিড় করেন অনেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবক। এ সময় শিক্ষার্থীদের করুণ মৃত্যুর দৃশ্য স্মরণ করেন বেশ কয়েকজন অভিভাবক। একপর্যায়ে শিক্ষক মাহেরিন চৌধুরীর প্রসঙ্গ তুলে তারা বলেন, উনি খুব ভালো একজন শিক্ষক ছিলেন। আমাদের বাচ্চাদের প্রতি অত্যন্ত আদর ও দায়িত্বশীল ছিলেন।

আশরাফুল ইসলাম নামে স্কুলটির একজন স্টাফ বলেন, মাহেরিন ম্যাডাম অনেক ভালো মানুষ ছিলেন।

মাহেরিন চৌধুরীর পারিবারিক পরিচয়ও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাতিজি। বাবার নাম মহিতুর রহমান চৌধুরী ও মা সাবেরা চৌধুরী। মাহেরিনের দাদি রওশানারা চৌধুরী ছিলেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের খালা। মাহেরিনের ভাই মুনাফ মুজিব চৌধুরী আমার দেশকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

বোন সম্পর্কে নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এক পোস্টে মুনাফ মুজিব চৌধুরী লেখেন, ‘মাহেরিন আপু আর আমাদের মাঝে নেই। আমার বড় বোন, যিনি আমাকে মায়ের মতো করে বড় করেছেন।’

মাহেরিনের স্বামী মনসুর হেলাল বলেন, ‘ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত সব পুড়ে গেছে। আমার মনে হয় ১০০ শতাংশ দগ্ধ। তবু লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার আগে সে আমাকে বলেছেÑও বের হচ্ছিল স্কুল ছুটি শেষে, তখনই বিমানটি পড়ে। ও নিজে দগ্ধ হয়েও বাচ্চাদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছে।

উদ্ধারকর্মীরা জানিয়েছেন, বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর যখন আগুন ও ধোঁয়ায় চারদিক ছেয়ে যায়, তখন শিক্ষক মাহেরিন নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে শুরু করেন। তিনি দ্রুততার সঙ্গে অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থীর প্রাণ বাঁচান বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।

মাহেরিন সম্পর্কে প্রথিতযশা সাংবাদিক ফজল এম কামাল তার ফেসবুক পোস্টে লেখেন, তিনি একজন মহান মানুষ। সন্দেহের কোনো কারণ নেই যে, তিনি কর্তব্য এবং দায়িত্ববোধের এক অকপট বোধ নিয়ে সন্তানতুল্য শিশুগুলোর জীবন বাঁচাতে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। একজন শিক্ষকের আদর্শকে তিনি সুমহান করেছেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মাহেরিন সম্পর্কে পার্থ সারথি মজুমদার বলেন, উনারা শিক্ষক নন, উনারা প্রকৃত মা। যারা নিজেদের জীবনের পরোয়া না করে অনেক বাচ্চাকে বাঁচিয়েছেন। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ওনাদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা উচিত।

ইসরাত জাহান সুমি নামে আরেকজন বলেন, ‘শিক্ষিকা স্কুল-কলেজে মায়ের প্রতিচ্ছবি। প্রমাণিত হলো। আল্লাহ তাআলা ওনাদের বেহেশত নসিব করুন, আমিন।’

সিনিয়র সাংবাদিক রহুল আমিন রূশদ বলেন, মানারাত ইউনিভার্সিটিতে তার স্ত্রীর ক্লাসমেট ছিলেন মাহেরিন। তিনি খুব অমায়িক মানুষ ছিলেন। তার মৃত্যুতে আমার স্ত্রী খুব কান্নাকাটি করছেন।

জানা গেছে, বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় স্কুলটির মাসুকা বেগম নামে আরেক শিক্ষকের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া আরো ছয়জন শিক্ষক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

জলঢাকায় দাফন, শিক্ষানুরাগী হিসেবে পরিচিত ছিলেন মাহেরিন চৌধুরী

নীলফামারী জেলা প্রতিনিধি আব্দুর রাজ্জাক জানান, শিক্ষক মাহেরিন চৌধুরী তার নিজ গ্রামে শিক্ষানুরাগী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। গতকাল মঙ্গলবার নীলফামারী জেলার জলঢাকা উপজেলার নিজ গ্রামে ওই শিক্ষকের গ্রামের লোকজনের কাছ থেকে এ কথা জানা যায়।

এ সময় তাকে শেষ বিদায় জানায় তার পরিবার ও গ্রামবাসী। মাহেরিন চৌধুরীকে হারিয়ে শোকে ভেঙে পড়েছেন পরিবারের লোকজন। এর আগে সকালে ঢাকায় এক দফা জানাজা শেষে তার লাশ ঢাকা থেকে জলঢাকা উপজেলার নিজ গ্রামে আনা হয়। বিকাল বেলা ৩টায় স্থানীয় কলেজ মাঠে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। এ সময় পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে।

মাহেরিন চৌধুরী জলঢাকা উপজেলার বগুলাগাড়ী গ্রামের মৃত মহিতুর রহমান চৌধুরীর মেয়ে এবং বগুলাগাড়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি। গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকেই জেলার জলঢাকা পেরৗসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বগুলাগাড়ী গ্রামে তাকে দাফনের প্রস্তুতি শুরু হয়।

তার প্রতিবেশী আব্দুল জব্বার জানান, দুই ঈদ ও মাঝেমধ্যে গ্রামে আসতেন মাহেরিন। এ সময় এলাকার গরিব মানুষকে আর্থিক সহযোগিতা করতেন তিনি। স্থানীয়ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কালভার্ট নির্মাণেও সহযোগিতা করেছেন। শিক্ষানুরাগী হিসেবে বগুলাগাড়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি হিসেবে তাকে মনোনীত করেছে এলাকাবাসী।

নিহতের স্বামী মনছুর হেলাল বলেন, ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীদের নিয়ে বের হওয়ার সময় বিমান দুর্ঘটনাটি ঘটে। এ সময় মাহেরিন সামান্য আঘাত পায়। কিন্তু ২০ থেকে ২৫ জন শিক্ষার্থী ভেতরে আটকা পড়ে যায়। বিষয়টি সে মোবাইলে আমাকে জানায় এবং তাদের উদ্ধারে ভেতরে ঢুকে পড়ে। এ সময় সে অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাতে মারা যায়।

মাহেরিনের পা থেকে মাথা পর্যন্ত পুরো শরীরই ঝলসে গিয়েছিল। চিকিৎসকরা ৮০ ভাগ দগ্ধের কথা বললেও তার মনে হয়েছিল সে শতভাগ দগ্ধ হয়েছিল। বার্ন ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়ার আগেও তিনি স্বামীর সঙ্গে কথা বলতে পেরেছিলেন। অবশেষে রাত ১০টা ১০ মিনিটে তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে তিনি দুই সন্তান (ছেলে) রেখে গেছেন।

আপনার সামাজিক মাধ্যমে খবরগুলো শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved by BUD News 24-2025
Developed BY www.budnews24.com