শনিবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:১৯ অপরাহ্ন

নারী ক্রিকেটে ‘নীরব ধর্ষণ’, বিসিবি কি যৌন শিকারিদের অভয়ারণ্য?

  • সময়: শনিবার, ৮ নভেম্বর, ২০২৫, ১১.২১ এএম
  • ৯ জন

জাহানারা আলম কাঁদছেন। কান্নার দমকে ফোঁপাচ্ছেন। জমে থাকা অব্যক্ত কথাগুলো গলায় আটকে যাচ্ছে। জোরে নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলালেন এবং লম্বা সময় ধরে যে অভিযোগ করলেন তা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) তথা পুরো দেশের ক্রিকেটের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে।

ক্যাপ্টেন্সির কামড়াকামড়ি থেকে শুরু করে ম্যাচ ফিক্সিং, জুয়াড়িদের সঙ্গে দরদাম-দহরম মহরম; এমন অনেক কিছুই দেখেছে দেশের ক্রিকেট। তবে নারী জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক জাহানারা আলম তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ নিয়ে যেভাবে প্রকাশ্যে সবকিছু ফাঁস করলেন এবং কাঁদলেন, সেটা নেহাত শুধু একজন নারীর অসহায়ত্ব বা অভিযোগ নয়; এটি পুরো দেশের ক্রিকেট প্রশাসনের ভেতরের নৈতিক পচনের এক কুৎসিততম দৃশ্য!

এই অভিযোগ বাংলাদেশের গোটা ক্রীড়া প্রশাসনের নৈতিকতার ভিত্তিকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো জাহানারা আলম মিডিয়ার কাছে এই অভিযোগ করেছেন মাত্র দিন কয়েক আগে। কিন্তু তার অভিভাবক সংস্থা বিসিবিকে তিনি জানিয়েছিলেন বছর দুয়েক আগেই। কী আশ্চর্য! এত ভয়াবহ অভিযোগ, অথচ বিসিবি সেটা পুরোদস্তুর চেপে যায়। অনুশীলনে, ম্যাচ চলাকালে, পুরস্কার মঞ্চে- বিভিন্ন স্থানে কোচ, ম্যানেজার ও মিডিয়া উইংয়ের দায়িত্বে থাকা কর্তাব্যক্তির নাম উল্লেখ করে তিনি বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজামুদ্দিন চৌধুরী সুজনের কাছে লিখিত জানান।

কিন্তু বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজামুদ্দিন সুজন কোনো ব্যবস্থা নেননি।

প্রশ্ন উঠেছে-প্রধান নির্বাহী কেন কোনো ব্যবস্থা নেননি? বিসিবির ব্র্যান্ড ইমেজ ক্ষুণ্ণ হবে বলেই কি তিনি এমন ভয়াবহ ঘটনা চেপে গিয়েছিলেন? শুধু একবার চিন্তা করুন- একজন নারী ক্রিকেটার, যিনি দেশের সাবেক অধিনায়ক ছিলেন। যিনি ১৬ বছর জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন। ক্রিকেটে তার ক্যারিয়ার ১৮ বছরের। দেশে-বিদেশে খেলেছেন গর্বের সঙ্গে। সেই তিনি যখন তার বিভাগের কর্তাব্যক্তিদের যৌন লিপ্সার শিকার হচ্ছেন, আর সেই বিষয়টি অফিসের শীর্ষকর্তারা জানার পরও মুখ বুজে চুপ করে থাকেন, তখন একসঙ্গে অনেক প্রশ্ন উঠে আসে।

– কেন এই নীরবতা?

– নারী ক্রিকেটারদের নিরাপত্তা আজ কোথায়?

– বিসিবি এই যৌন হয়রানির অভিযোগ গোপন রাখতে বেশি আগ্রহী কেন হয়েছিল?

– এই ‘নীরব ধর্ষণ’ সংস্কৃতির দায় কি বিসিবির নয়?

এসব প্রশ্নের উত্তর জানাচ্ছে, জাহানারা আলমের বিরুদ্ধে এই যৌন হয়রানি কেবল কোনো এক ব্যক্তির ঘটনা নয়, এই অপরাধের সঙ্গে একটি যৌন শিকারির দল জড়িত। এই ঘটনার সঙ্গে এটি মূলত ক্ষমতা ও প্রভাবের অপব্যবহার। ভাবার কোনো কারণ নেই যে শুধু অ্যাডভেঞ্চার ও কারো বিরুদ্ধে স্রেফ অভিযোগ আনতে হবে বলেই জাহানারা এমন বিস্তারিতভাবে এসব অভিযোগ করেছেন। মুক্তচিন্তা, স্বাধীন আকাশ, সুন্দর ভাবনা, স্বাচ্ছন্দ্যের সময়- এমন আলোকিত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে যেখানে একজন ক্রিকেটারের ডানা মেলে আকাশে উড়ার কথা, সেখানে দিন-সপ্তাহ-মাস ও বছর ধরে সেই ক্রিকেটারকে প্রতিটা মুহূর্ত লড়তে হয়েছে একসঙ্গে অনেকগুলো পটেনশিয়াল রেপিস্টের বিরুদ্ধে!

তাও আবার সম্পূর্ণ একা! এমন একদল নেকড়ের লোলুপতা থেকে প্রতি মুহূর্তে নিজেকে রক্ষার জন্য দুশ্চিন্তায় ভোগা ক্রিকেটার তার ক্রিকেট খেলবেন কীভাবে? তার তো খেলার প্রতি ভালো লাগা, ভালোবাসার মন জানালা সবকিছুই তখন রুদ্ধ!

যে বিশ্বাস, যে আস্থা নিয়ে তার ক্রিকেট মাঠে নিজের নৈপুণ্য মেলে ধরার কথা ছিল সেটা তো নষ্ট করে দিলেন স্বয়ং তার সবচেয়ে বড় অভিভাবক কোচ এবং ম্যানেজার! সেই বিশ্বাসের আয়নাটা আরো ভেঙেচুরে একাকার হয়ে গেল যখন জাহানারা আলম দেখলেন তার পাশে কেউ নেই। বরং অভিযুক্তদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ঠাট্টার হাসি হাসছে প্রশাসন!

যিনি অভিযোগ করেছেন তিনি কোনো প্রতিকার পেলেন না। উল্টো অভিযুক্তদের তল্পিবাহক হয়েই থাকল বিসিবি। এই দায়মুক্তির সংস্কৃতি জানাচ্ছে বিসিবি আজ অপরাধী। যখন কোনো প্রতিষ্ঠান অপরাধের সামনে নীরব থাকে, তখন সেই নীরবতাই তার বড় অপরাধ। কোনো সন্দেহ নেই জাহানারা আলমের সঙ্গে যা ঘটেছে তা শুধু একজনের অপরাধ নয়, এটি সার্বিক অর্থে বিসিবির প্রশাসনিক ব্যর্থতাÑএটি পুরো প্রতিষ্ঠানের নৈতিক অপরাধ। এটা নারী ক্রিকেটে প্রাতিষ্ঠানিক সহিংসতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ!

বিসিবি এখন তাহলে পোটেনশিয়াল রেপিস্টদের আবাস!

এই লজ্জার দায় থেকে মুক্তি পেতে বিসিবির সামনে এখন একটাই উপায় নীরবতার দেয়াল ভেঙে ফেলা। এই অপরাধের সঙ্গে সমান, অসমান, সামান্য-বেশি যারাই জড়িত তাদের প্রত্যেকের মুখোশ খুলে দেওয়া। প্রয়োজন স্বচ্ছ তদন্ত, অভিযুক্তদের তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত ও কঠোর জবাবদিহিতায় নিয়ে আসা।

আর যদি তা না হয় তাহলে মিরপুরে বিসিবির সাইনবোর্ড থেকে হোম অব ক্রিকেটÑএই ট্যাগলাইন মুছে লিখে দেওয়া উচিত সেফ জোন অব রেপিস্ট!

আপনার সামাজিক মাধ্যমে খবরগুলো শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved by BUD News 24-2025
Developed BY www.budnews24.com