জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন ইস্যুতে গণভোটের পক্ষে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই এই গণভোট অনুষ্ঠিত হবে-এ ব্যাপারে বিএনপি, এনসিপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল একমত। এক্ষেত্রে বিএনপিসহ সমমনা জোট তাদের আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী প্রকাশ্যে সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট চায়। কিন্তু সূত্র বলছে, নির্বাচনের দিনে গণভোট হলেও তারা আপত্তি করবে না।
এছাড়া এর আগে সংবিধান বিশেষজ্ঞরাও নির্বাচনের দিন গণভোটের সুপারিশ করেছিলেন। সবমিলিয়ে গণভোটের ব্যাপারে কোনো দলের আপত্তি নেই। কিন্তু সেটি সংসদ নির্বাচনের দিন নাকি আগে, সেই সময়টা নিয়ে আরও আলোচনা হবে। বুধবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চূড়ান্ত বৈঠকে এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত আসবে। সবকিছু ঠিক থাকলে নির্ধারিত সময়ে অর্থাৎ অক্টোবরের মধ্যেই জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে দলগুলো। রোববার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে এসব বিষয়ে চূড়ান্ত হয়। বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একধরনের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারা জনগণের সম্মতি অর্জনের জন্য গণভোটের বিষয়ে একমত হয়েছে।
এ সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোটে কোনো বাধা নেই। সনদে কী আছে, তা জনগণের কাছে উন্মুক্ত থাকবে। এই জনরায় হবে চূড়ান্ত। আগামী সংসদ গণভোটের রায় মানতে বাধ্য থাকবে।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের বিষয়ে সব রাজনৈতিক দল একমত। তবে গণভোট সংসদ নির্বাচনের আগে না পরে, এটা আলোচনার সুযোগ আছে। আমাদের দল গণভোট নির্বাচনের আগেই চায়।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, সব রাজনৈতি দল গণভোটের ব্যাপারে একমত হয়েছে। এ গণভোট সাধারণ নির্বাচনের দিনই করা যেতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, জুলাই সনদের ৮৪টি প্রস্তাব। এ ধারাগুলো গণভোটে যাবে না। ব্যালটে উল্লেখ থাকবে, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হবে কি না? সেক্ষেত্রে ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’-এই সিদ্ধান্তে জনগণ তাদের রায় দেবে। সূত্র আরও জানায়, গণভোট বিশাল ব্যয়বহুল এবং বড় প্রস্তুতির বিষয়। এক্ষেত্রে জাতীয় নির্বাচনের আগে এত ব্যয়বহুল সিদ্ধান্তে সরকার যাবে না। ফলে সংসদ নির্বাচনের দিনই ভিন্ন ব্যালটে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। এটি মোটামুটি চূড়ান্ত। এখন আনুষ্ঠানিক ঘোষণার বাকি।
রোববারের বৈঠক শেষে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এক্ষেত্রে দলগুলোর মধ্যে একধরনের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জনগণের সম্মতি অর্জনের জন্য গণভোটের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে। তিনি বলেন, দলীয় অবস্থান থেকে সরে এসে রাজনৈতিক দলগুলো একটি জায়গায় আসার জন্য সচেষ্ট হয়েছে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর একমত হওয়াকে আমরা সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার প্রথম বড় পদক্ষেপ হিসাবে দেখছি।’ এর আগে ১১, ১৪ ও ১৭ সেপ্টেম্বর তিনটি বৈঠক হয়। এরপর দলগুলোর পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার জন্য কিছু সময় দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় তারা কাজে লাগিয়েছে। ফলে গণভোট ও সাংবিধানিক সংস্কার নিয়ে দলগুলোর মধ্যে অভিন্ন অবস্থান তৈরি হয়েছে।’
আলী রীয়াজ বলেন, ‘ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে যে আইনসভা গঠিত হবে, সেটিকে এমন বৈশিষ্ট্য দিতে হবে, যাতে জুলাই সনদের ভিত্তিতে প্রস্তাবিত সাংবিধানিক সংশোধনগুলো সহজে সম্পন্ন করা যায়। এ বিষয়েও কার্যত রাজনৈতিক দলগুলো একমত।’ তিনি আরও জানান, এর আগে দলগুলোর একাংশ সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্টের মতামত নেওয়ার কথা বলেছিল। বর্তমানে অধিকাংশ দলই মনে করছে, এর আর প্রয়োজন নাও হতে পারে।
রাজনৈতিক দলগুলোর ‘সহনশীলতা’ ও ‘অবস্থান পরিবর্তনের সাহসিকতা’কে স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘তারা দলীয় অবস্থান থেকে সরে এসে জাতীয় ঐক্য তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এটা বড় ধরনের অগ্রগতি।’ তিনি জানান, কমিশনের অগ্রগতির বিষয়ে রোববার সকালেই প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূসকে অবহিত করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা দ্রুততার সঙ্গে সুপারিশ চূড়ান্ত করার তাগিদ দিয়েছেন। আলী রীয়াজ বলেন, ‘১৫ অক্টোবরের মধ্যেই সুপারিশ চূড়ান্ত করে সরকারের কাছে দিতে কমিশন আশাবাদী। ইতোমধ্যে আলোচনায় যুক্ত ৩০টি দলের তিন-চতুর্থাংশ সনদে স্বাক্ষরের জন্য প্রতিনিধিদের নামও কমিশনে পাঠিয়েছে।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় ফাইনাল স্টেজে আমরা আছি। সংসদ নির্বাচনের দিন জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট হতে পারে। মোটামুটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে, একমত হয়েছি। জুলাই সনদ-২০২৫ বাস্তবায়নে অধ্যাদেশও জারি করা যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, ১০৬ অনুচ্ছেদের আওতায় বিচার বিভাগের পরামর্শ নেওয়ার দাবি থেকে সরে এসেছে বিএনপি। আমরা এখন জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ নামে অধ্যাদেশ জারি এবং এরপরে গণভোটের পক্ষে আমরা। এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপি নেতা বলেন, জনগণের কাছে বলতে হবে, ‘আমরা রাজনৈতিক দল জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর করেছি, অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছি, জনগণ তার পক্ষে আছে কি না। এরপর তারা যদি রায় দেয়, তখনই জনগণের পক্ষ থেকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে চূড়ান্ত অভিমত মিলবে।’
তিনি বলেন, গণভোটের জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন নেই। এ সংক্রান্ত আর্টিকেল ১৪২ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ উড়িয়ে দিয়েছিল। হাইকোর্ট সেটি পুনর্বহাল করেছে। এখন গণভোট করা যাবে না-সংবিধানের আর কোথাও এমন কোনো বিধান নেই। সুতরাং একটা অধ্যাদেশ জারি করে নির্বাচন কমিশনকে এখতিয়ার দেওয়া যেতে পারে, একই দিনে সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি আলাদা ব্যালটে গণভোট করতে হবে। সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, গণভোটের মাধ্যমে যে রায় আসবে, সেটা সার্বভৌম ক্ষমতার একটা রায়। সুতরাং সব সংসদ-সদস্য সেটা মানতে বাধ্য হবেন।’
সনদের বিভিন্ন ধারার ওপর ‘নোট অব ডিসেন্ট’ নিয়ে প্রশ্নের জবাবে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘জুলাই সনদ প্রণীত হবে, স্বাক্ষরিত হবে। অঙ্গীকারনামায় সবাই সই করবে। এগুলো ওয়েবসাইটে যাবে। সব দলের নির্বাচনি ইশতেহারে থাকবে। তিনি বলেন, জনগণ জানবে জুলাই সনদে কী আছে। যারা ম্যান্ডেট পাবে, তারা তাদের নোট অব ডিসেন্ট অনুসারে যেতে পারবে।’
হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘জনগণ গণভোটে অভ্যস্ত নয়। ফলে আমরা মনে করি, জাতীয় নির্বাচনকে কোনো ধরনের সমস্যা করা ছাড়া নভেম্বর অথবা ডিসেম্বরে গণভোট হতে পারে। নির্বাচনের তফশিলের আগেও হতে পারে। গণভোট হয়ে গেলে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে কোনো ধরনের বাধা নেই। জনগণকে একটা জটিল অবস্থায় ফেলে না দিয়ে সহজভাবে এগোলে আমরাও বাঁচি, জাতিও বাঁচে।’ জামায়াতের এই নেতা বলেন, গণভোট হলে এটা কখনো চ্যালেঞ্জ করতে গেলে টিকবে না। সংসদ এটাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘গণভোটের রেজাল্ট আমাদের বিপক্ষে গেলেও আমরা এখানে ছাড় দেব। আমরা জনগণের সিদ্ধান্তকে মেনে নেব। এটি নিয়ে আমাদের কোনো আপত্তি থাকবে না।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে জামায়াতের এই নেতা বলেন, গণভোট আগে না পরে, এটা আলোচনার সুযোগ আছে। সবাই গণভোটের পক্ষে একমত হয়েছে। গণভোট আয়োজন করবে নির্বাচন কমিশন। তার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে একটা নিদের্শনা দিতে হবে। এরপর কমিশন গণভোটের আয়োজন করতে পারবে।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেছেন, জুলাই সনদের আইনি ও সাংবিধানিক ভিত্তি নিশ্চিত করতে গণভোট আয়োজনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একধরনের ঐক্য তৈরি হয়েছে। আমরা বলতে পারি, প্রায় সব রাজনৈতিক দলই একমত হয়েছে, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি আগে নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, কমিশন একসময় প্রস্তাব দিয়েছিল ‘সংবিধান আদেশ’ জারির। আবার কিছু দল বলেছিল ‘লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার’ বা ‘রেফারেন্ডাম অধ্যাদেশ’ করতে। আমরা বলেছি, নাম যেটাই হোক, সংবিধান আদেশ, লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার বা রেফারেন্ডাম অধ্যাদেশ-এই ভিত্তিতে গণভোট হতে হবে। সেটি সাধারণ নির্বাচনের দিনেই করা যেতে পারে। তিনি আবারও দাবি করেন, পরবর্তী নির্বাচিত সংসদ দ্বৈত ক্ষমতাসম্পন্ন করতে হবে। নির্বাচিত সংসদ শুধু আইন প্রণয়নকারী সংসদ হিসাবে কাজ করবে না।
প্রসঙ্গত, জুলাই সনদ চূড়ান্ত হলেও বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে এতদিন রাজনৈতিক দলগুলোর মতভিন্নতা ছিল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চূড়ান্ত সনদে ৮৪টি প্রস্তাবের মধ্যে ২৯টি প্রস্তাব নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়ন করা যায়। ২১টি রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে এবং ৩৪টি প্রস্তাব বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। এক্ষেত্রে নির্বাহী আদেশ এবং অধ্যাদেশের মাধ্যমে যেসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা যায়, সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের ব্যাপারে সব দল একমত। কিন্তু সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত ধারার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো ছিল মুখোমুখি অবস্থানে। বিএনপি চেয়েছিল সংসদ-সদস্যরা সংবিধান সংশোধন করে সনদ বাস্তবায়ন করবে। এছাড়াও সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্টের মতামত নেওয়ার পক্ষে মত ছিল দলটির। জামায়াতে ইসলামী চায় আপাতত সংবিধান আদেশ জারি করে সনদ বাস্তবায়ন করা হবে। এরপর নির্বাচনের আগেই গণভোটের মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে সনদ বাস্তবায়ন। এ দাবিতে ইতোমধ্যে রাজপথে আন্দোলনে রয়েছে দলটি।
এনসিপির দাবি ছিল গণ পরিষদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন। এ দাবিতে দলগুলো তাদের অবস্থানে অনড় ছিল। কিন্তু রোববারের আলোচনায় দলগুলো সেখান থেকে সরে এসেছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোকে একই প্ল্যাটফর্মে আনতে কমিশনের মেয়াদ ইতোমধ্যে তিন দফা বাড়িয়েছে সরকার। ১৫ অক্টোবর এই মেয়াদ শেষ হবে। তবে ১০ অক্টোবরে মধ্যে সনদ চূড়ান্ত করতে চায় কমিশন। এক্ষেত্রে ৮ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আরেক দফা বৈঠক। এরপর বৈঠক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে। বাকি আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সনদ চূড়ান্ত করবে।