সাভারবাসীর জন্য এক বিভীষিকাময় দিন ছিল ২০২৪ সালের ২১ জুলাই। পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের গুলিতে এদিন ছয়জন নিহত হন, আহত হন শতাধিক। এদিন কারফিউ অমান্য করে ছাত্র-জনতা ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে বিক্ষোভ ও কেন্দ্র থেকে ঘোষিত সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচি কমপ্লিট শাটডাউনে অংশগ্রহণ করেন।
সকাল থেকেই তৎকালীন ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) বর্তমানে কারাবন্দি আবদুল্লাহিল কাফীর নেতৃত্বে মহাসড়ক থেকে আন্দোলনকারীদের ওপর দফায় দফায় গুলি চালিয়ে তাদের হটিয়ে দেয়। পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা যৌথভাবে শক্তি প্রদর্শন এবং অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মোটরসাইকেলে শোডাউন করে।
এদিন অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন ছিল। তারা এপিসি, জলকামানসহ সাভার ও আশুলিয়ায় কড়া পাহারা দিতে থাকে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সাভার থানা বাসস্ট্যান্ড ও পাকিজা মোড়ে পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ বাধে। দুপুরের পর থেকে রাতভর সাভার পৌর এলাকায় প্রায় অর্ধশত বিএনপি নেতার বাড়িঘরে লুটপাট চালায় তারা। আন্দোলনকারী ও নিরীহ পথচারী প্রায় শতাধিক ব্যক্তিকে এদিন পুলিশ আটক করে কারাগারে পাঠায়।
এর আগের দিন ২০ জুলাই পুলিশের গুলিতে সাভার বাসস্ট্যান্ডের কাঁচাবাজারে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। গুলিতে মুরগির দোকানি কুরবান শেখ ও ফারুক হোসেন নিহত হন। আহত হন প্রায় অর্ধশত। এ ছাড়া বাসস্ট্যান্ড ও পাকিজা মোড়ে আরো তিন ব্যক্তি পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন।
২১ জুলাই সকাল থেকে বিক্ষোভ দমাতে পুলিশ টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। বিপুলসংখ্যক ছাত্র-জনতা ইটপাটকেল নিক্ষেপ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। থানা বাসস্ট্যান্ড, পাকিজা মোড়, সাভার বাসস্ট্যান্ড, শিমুলতলা, রেডিও কলোনি, বিশমাইল, পল্লীবিদ্যুৎ, পলাশবাড়ী, বাইপাইল, জামগড়াসহ সব গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে পুলিশকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। একপর্যায়ে পুলিশ শটগান ও ছররা গুলি চালায়।
দুপুরের পর থেকে পুলিশ সাভার পৌর এলাকায় বিএনপি ও ভিন্নমতের ব্যক্তিদের বাসা ও অফিসে লুটপাট চালায়। ঢাকা জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর খোরশেদ আলম জানান, ২১ জুলাই পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা তাকে না পেয়ে ছায়াবিথী মহল্লায় তার শ্বশুর শহীদুল্লাহ কায়সারের বাসায় অতর্কিত হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। তার বাসায় থাকা ভেটেরিনারি ওষুধ ব্যবসার নগদ ৩৪ লাখ টাকা, ২০-২২ ভরি স্বর্ণ, টিভি, ফ্রিজ, মোবাইল ফোন লুট করে নিয়ে যায়। এ ছাড়া গুলি করে বাসার এসি, পানির পাম্প, ফ্যান, ওয়াশরুমের কমোডসহ নানা আসবাবপত্র ঝাঁঝরা করে দেয়।
একই কায়দায় পুলিশ রেডিও কলোনি এলাকায় পৌর বিএনপি নেতা সোহরাব হোসেন, সাইফুর রহমান, মজিদপুর এলাকায় পৌর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও পৌর কাউন্সিলর আবদুর রহমানের বাসায় লুটপাট চালায়। আবদুর রহমানের স্ত্রী দিলরুবা আক্তার রুমী জানান, তার বাসা থেকে ৪০ ভরি স্বর্ণ, নগদ টাকা, মোবাইল ফোন লুটে নেওয়া হয়েছে। পুলিশ বাসার টিভি-ফ্রিজ, এয়ারকুলারসহ বিভিন্ন তৈজসপত্র ভেঙে তছনছ করে। তারা একই কায়দায় সাভার বাসস্ট্যান্ডে সিটি সেন্টার ভবনে থাকা বিএনপি নেতা ব্যবসায়ী ওবায়দুর রহমান অভির বাসায় লুটপাট চালিয়ে কোটি টাকা লুটপাট ও ক্ষতিসাধন করে। তারা একই দিনে আইচানোয়াদ্দায় যুবদল নেতা ইউনুস খানের বাড়িতে হামলা চালায় এবং ভাঙচুর ও লুটপাট করে। পর্যায়ক্রমে অর্ধশত বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়িতে পুলিশ ও সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে লুটপাট ও ভাঙচুর করে।
ভিন্নমতের হওয়ায় এবং ছাত্রদের পক্ষে সংবাদ প্রকাশ করায় এদিন সাভার বাসস্ট্যান্ড-সংলগ্ন স্থানীয় দৈনিক ফুলকি অফিসে হামলা করে পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। তারা অফিসের চারটি কম্পিউটার, দুটি টিভি, সিসি ক্যামেরা, দরজা জানালার গ্লাস, ওয়াশরুমের কমোডসহ নানা দ্রব্যসামগ্রী ভাঙচুর ও দুটি কম্পিউটার লুটে নেয়। এ সময় দৈনিক ফুলকির বার্তা সম্পাদক নজমুল হুদা শাহীনকে ধরে তাদের গাড়িতে তুলে নিতে প্রধান সড়কে পুলিশ ভ্যানের কাছে নিয়ে যায়। একপর্যায়ে তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন রেখে ও পত্রিকার সম্পাদক তার বড়ভাই নাজমুস সাকিবের অবস্থান জানতে চেয়ে জিজ্ঞাসা বাদ করে ছেড়ে দেয়।