জাতীয় গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স দেওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। ক্ষমতাসীন দলের আদর্শ প্রচারে ব্যবহৃত হওয়ার পাশাপাশি এসব গণমাধ্যম স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ছিল। কমিশন বলছে, আইন উপেক্ষা করে ক্ষমতাবান ও দলীয় পরিচয়ধারীরা লাইসেন্স পেয়েছেন, যা গণতন্ত্রের জন্য ছিল ভয়ংকর।
গত বছরের ১৮ নভেম্বর সাংবাদিক কামাল আহমেদের নেতৃত্বে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। গত ২২ মার্চ কমিশন ২০ দফা সুপারিশসংবলিত প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেয়। পরে অবশ্য তারা স্বল্পমেয়াদে বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশ দিয়ে আরেকটি প্রতিবেদন জমা দেয়।
কমিশনের প্রতিবেনে উঠে এসেছে, শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরে ৩৮টি বেসরকারি টেলিভিশনের লাইসেন্স দেওয়া হয়। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ১০টি, ২০১১ সালে তিনটি ও ২০১৩ সালে ১৩টি চ্যানেলের লাইসেন্স দেওয়া হয়। ২০২৪ সালে বিতাড়িত হওয়ার আগে ১২টি চ্যানেল অনুমোদন দিয়ে যায়। তবে ফ্রিকোয়েন্সি সুবিধা না থাকায় সেগুলো সম্প্রচারে আসতে পারেনি। লাইসেন্স পাওয়া প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের নিজস্ব লোকজন ও তাদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী এবং আওয়ামী ঘরানার সাংবাদিক। দলটির মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত অনেকেই লাইসেন্স পেয়েছেন। অনেকেই সরকারি পদে থেকেও আবেদন করে টিভি ও এফএম রেডিও চ্যানেলের লাইসেন্স পেয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ নেতাদের পরিবারের সদস্যদের লাইসেন্স দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গণমাধ্যমের অনুমতি বা লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে সব আইন ও নীতিমালা উপেক্ষা করে রাজনৈতিক পরিচয়কে প্রধান বিবেচ্য হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। আবেদনকারীরা ‘আওয়ামী লীগের কর্মী’ পরিচয় ও ‘আওয়ামী লীগের আদর্শ প্রচারের জন্য টেলিভিশনের লাইসেন্সের জন্য’ আবেদন করে অনুমোদন পেয়েছেন। ২০০৯ সালের পর অনুমোদন পাওয়া টিভি চ্যানেলগুলোর একটি বড় অংশই দলীয় প্রচারের ঘোষণা বা অঙ্গীকারের মাধ্যমে লাইসেন্স নিয়ে স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে ও সক্রিয়ভাবে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছে।
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় এসব টিভি চ্যানেলে আন্দোলনকারী ছাত্রনেতাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার ও উসকানিমূলক বক্তব্য প্রচার করা হয় উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশ কয়েকটি সংবাদপত্রও সরাসরি আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের সশস্ত্র সমর্থকদের নিষ্ঠুর বর্বরতার পক্ষে সাফাই ও সমর্থন দিয়েছে। টেলিভিশন ছাড়াও বেশকিছু গণমাধ্যম সরকারের নির্দেশমতো আন্দোলনের প্রকৃত চিত্র তুলে না ধরে ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে নানারকম মনগড়া, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বিভ্রান্তিকর খবর প্রকাশ করে বলে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। কমিশন কয়েকটি পত্রিকার শিরোনামও তুলে ধরে।
কমিশনের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, লাইসেন্সপ্রাপ্তির আবেদনে এশিয়ান টিভির মালিক ও বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের সভাপতি হারুন অর রশীদ শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা বাস্তবায়নের অংশীদার হওয়া; ইনডিপেনডেন্ট টিভির আবেদনে সালমান এফ রহমান ও নাজমুল হাসান পাপন আওয়ামী লীগ সরকারের কর্মসূচি বাস্তবায়নে অবদান রাখা; বেঙ্গল গ্রুপের চেয়ারম্যান মোর্শেদুল আলম চ্যানেল ৫২-এর আবেদনে ‘২০২১ সালের রূপকল্প’ বাস্তবায়ন এবং চ্যানেল ২১-এর আবেদনে ‘ভিশন-২১ ও ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার স্বপ্ন; তিতাস টিভির আবেদনে ধানাদ ইসলাম দীপ্ত ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়া’; ইসমত কাদির গামা ২০২১ সালে চ্যানেল এস-এর লাইসেন্স পেতে নিজেকে ‘আওয়ামী লীগের একজন একনিষ্ঠ ত্যাগী কর্মী’ উল্লেখ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া; গ্লোবাল টিভির আবেদনে মো. মামুনুর রশীদ কিরণ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার কথা বলেন।
চ্যানেল নাইনের আবেদনপত্রে সরকারের উন্নয়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ ও ভিশন-২০২১ বাস্তবায়নের কথা উল্লেখ করা হয়। গ্রিন মাল্টিমিডিয়া লিমিটেডের চেয়ারম্যান সৈয়দ গোলাম দস্তগীর আবেদনপত্রে ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ও আদর্শ বাস্তবায়ন, প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়সহ ২০২১ সালের রূপকল্প বাস্তবায়নে গ্রিন টিভির মাধ্যমে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করার কথা উল্লেখ করেন।
রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করতে পারেনÑ এমন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ক্ষমতাবানরাই চ্যানেলের লাইসেন্স পেয়েছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক মন্ত্রী গাজী গোলাম দস্তগীর, বিসিবির সাবেক সভাপতি ও শেখ হাসিনার যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী নাজমুল হাসান পাপন, শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, শাহরিয়ার আলম, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ইসমত কাদির গামা, সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন বাবু, আহমেদ জোবায়ের, চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের সাবেক সভাপতি হারুন-অর-রশীদ, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা সাংবাদিক ইকবাল সোবহান চৌধুরী, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের ভাইয়ের স্ত্রী সৈয়দা মাহবুবা আক্তার, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, আওয়ামী লীগের এমপি মামুনুর রশীদ কিরণ এবং মোর্শেদ আলম।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেও বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলের আবেদন করা বিধিসম্মত না হলেও লাইসেন্স পেতে তাদের কোনো সমস্যা হয়নি।
রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা মিডিয়ার মালিকানা লাভের কারণে ওইসব প্রতিষ্ঠানে বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষভাবে সাংবাদিকতা চর্চার সুযোগ ছিল না। বরং মিডিয়ায় তারা নিজেদের ও সরকারের প্রচারণা করেছেন, যার অনেক উদাহরণ পতিত শেখ হাসিনা সরকারের সময় দেখা গেছে। ইকবাল সোবহান চৌধুরী আবেদনের মাত্র তিন দিনের মধ্যে অনাপত্তিপত্র পান বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে চ্যানেলের অনুমতি পেয়ে শেয়ার বিক্রির কথাও উঠে এসেছে। মোজাম্মেল বাবু একাত্তর টিভির লাইসেন্স পাওয়ার পর অর্ধেক শেয়ার বিক্রি করেন মেঘনা গ্রুপের কাছে। আহমেদ জোবায়ের সময় টিভির লাইসেন্স বিক্রি করেন সিটি গ্রুপের কাছে। এভাবে তারা মোটা অঙ্কের টাকার মালিক এবং চ্যানেল স্থাপনের খরচও জোগাড় করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আর্থিক সামর্থ্য থাকার পরও বড় অঙ্কের ব্যাংকঋণ নিয়ে চ্যানেল প্রতিষ্ঠা করতে দেখা গেছে। এর মধ্যে রয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপ। সালমান এফ রহমানের এই কোম্পানি ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন স্থাপনে ৩০০ কোটি টাকা ব্যাংকঋণ নিয়েছে বলে জানা যায়। দেশ টিভির লাইসেন্স বিএনপির সাবেক কূটনীতিক ও সংসদ সদস্য মুশফিকুর রহমানের হলেও পরে সাবের হোসেন চৌধুরী ও আসাদুজ্জামান নূর চ্যানেলটির কর্ণধার হন এবং বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়ে চ্যানেলটি স্থাপন করেন।
এদিকে প্রতিবেদনে নির্বাচন প্রভাবিত করতে স্থানীয় পত্রিকা প্রকাশের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, পাঁচ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের জন্য ৩২টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। অধিকাংশ পত্রিকা পয়সা দিয়ে কেনার মতো পাঠক নেই। কমিশনের মতবিনিময়ে উঠে এসেছে, নির্বাচনের সময় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিক পরিচয়ে নিজস্ব কর্মীদের নিয়োগ দেওয়ার জন্য পত্রিকা প্রকাশ করেন। জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন থেকে অস্বাভাবিক উচ্চসংখ্যায় অ্যাক্রিডিটেশনের ব্যবস্থা করা হয়। এসব কর্মীর কাজ ছিল ভোটকেন্দ্রে প্রকৃত সাংবাদিকদের বঞ্চিত করা, কারচুপিতে সহায়তা করা বা আড়াল করা। কমিশনের প্রতিবেদন অনুসারে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থা একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের জন্য অর্থ দিয়েছিল। কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশের পর পত্রিকাটির তহবিল বন্ধ হয়ে যায়। পত্রিকাটির নামে গোয়েন্দা সংস্থা অনলাইন একটি পোর্টাল বেশ কিছুদিন চালু রেখেছিল।
জাতীয় গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ আমার দেশকে বলেন, কমিশন যে তথ্য পেয়েছে, তা প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। আমাদের মনে হয়েছে বেসরকারি টেলিভিশনগুলোর অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে আইন ও বিধি উপেক্ষা করে দলীয় পরিচয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই হয়নি বলেও কমিশনের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।