বাংলাদেশের রাজনীতিতে সিপিবি, বাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ বাম রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা নিয়ে জনগণের মধ্যে আবার প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, বেশিরভাগ বামদল এখনো ভারতের লেজুড়বৃত্তি এবং আওয়ামী লীগের বি-টিম হয়ে কাজ করছে। বাম দলগুলো মাঝেমধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে আওয়ামী লীগের কিছু সমালোচনা করলেও প্রকৃতপক্ষে তারা একে অপরের পরিপূরক হিসেবেই কাজ করছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বাংলাদেশের বাম রাজনীতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে বিভিন্ন ইস্যুতে তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করেছে কিংবা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। বিএনপি কিংবা ইসলামপন্থি দলগুলোর সঙ্গে কখনো দেখা যায়নি। তেমনি ভারতীয় স্বার্থকেই তারা প্রাধান্য দিয়েছে। বাংলাদেশের স্বার্থের পক্ষে ভারতের বিরুদ্ধে তাদের কখনো কোনো জোরালো প্রতিবাদ ও অবস্থান দেখা যায়নি।
আওয়ামী লীগ গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী শাসন চালিয়েছে। রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের কিংবা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তারা বড়জোর মৃদু ভাষায় কথা বলেছে। অনেক ক্ষেত্রে চুপ থেকে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসন টিকিয়ে রাখতে তারা সহায়তা করেছে। বিএনপি-জামায়াতের ওপর দমনপীড়ন, খুন-গুম নিয়ে তারা কমই কথা বলেছে।
গত জুলাই বিপ্লবে ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারের পতন হলেও পরাজিত আওয়ামী লীগ দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। জনরোষের ভয়ে সরাসরি তারা সামনে আসতে পারছে না। এক্ষেত্রে তাদের সব সময়ের সহযোগী শক্তি বামদের ওপর ভর করে এগুচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিবেশী ভারতের ইন্ধনও রয়েছে এসব আন্দোলনে। সর্বশেষ ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন ইস্যুতে তারা মাঠ গরম করার চেষ্টা করে। তবে তাতে জনগণের সমর্থন মেলেনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গত কিছুদিন ধরে ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় যে অস্থিরতা বিরাজ করছে তা পরাজিত আওয়ামী লীগ ও প্রতিবেশী ভারতের মাস্টারপ্ল্যানের অংশ। ধর্ষণ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ইস্যুকে সামনে রেখে বাম রাজনৈতিক দল এবং তাদের সহযোগী সংগঠনগুলোকে পরিকল্পিতভাবে মাঠে নামানো হচ্ছে। একই সঙ্গে গণজাগরণ মঞ্চের সেই কুশীলবরাও সক্রিয়। তারা শাহবাগের জাতীয় জাদুঘর প্রাঙ্গণ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, জাতীয় প্রেস ক্লাব, পল্টন মোড় প্রভৃতি এলাকায় সভা-সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি পালন করছে। এসব সংগঠনের কর্মসূচিতে যোগ দিচ্ছে আওয়ামী লীগের দোসররা।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদকে গত ১৫ বছরে কোথাও দেখা যায়নি। দেশে হত্যা, ধর্ষণ, নারী নিপীড়নের মহোৎসব চলেছে গত পনের বছর। তখন মহিলা পরিষদ মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিল। কিন্তু হঠাৎ করে তারা রাজপথে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ করে তারা বলছে, তারা নাকি এখন সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন।
রাজপথে বিশেষ করে শাহবাগে ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভানেত্রী লাকী আক্তারের নেতৃত্বে হঠাৎ গণজাগরণ মঞ্চের সক্রিয় হয়ে ওঠায় প্রশ্ন ওঠেছে গত বছরের জুন-জুলাই-আগস্টজুড়ে দেশব্যাপী গড়ে ওঠা কোটাবিরোধী আন্দোলন এবং হাসিনা পদত্যাগের এক দফা দাবির আন্দোলনে তো তাদের মাঠেই দেখা যায়নি, সেই বামরাই হুট করে এখন কেন রাজপথে সরব?
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের দু’প্রধান দলের একটি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, আরেকটি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ। অভিযোগ রয়েছে, বাম দল হিসেবে পরিচিত ওয়ার্কার্স পার্টি এবং জাসদেরও মদত রয়েছে সাম্প্রতিক আন্দোলনে। বিশেষ করে ওয়ার্কার্স পার্টির ছাত্র সংগঠন ‘ছাত্র মৈত্রী’, যুব সংগঠন ‘যুব মৈত্রী’, নারী সংগঠন ‘নারী মুক্তি সংসদ’, শ্রমিক সংগঠন ‘জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন’, গার্মেন্টস শ্রমিক-কর্মচারী ফেডারেশন ও ‘গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন’, কৃষক সংগঠন ‘জাতীয় কৃষক সমিতি’ এবং ক্ষেতমজুর ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা সক্রিয়ভাবে মাঠে নেমেছেন। একইভাবে মাঠে নেমেছেন জাসদের ছাত্র সংগঠন ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’, তাদের যুব সংগঠন ‘জাতীয় যুব জোট’, নারী সংগঠন ‘জাতীয় নারী জোট’, শ্রমিকদের সংগঠন ‘জাতীয় শ্রমিক জোট’, কৃষকদের সংগঠন জাতীয় কৃষক জোটের নেতাকর্মীরাও।
আওয়ামী লীগের শরিক গণতন্ত্রী পার্টির ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্র ঐক্য, যুব সংগঠন ‘জাতীয় যুব ঐক্য’, সাম্যবাদী দলের (এমএল) ছাত্র সংগঠন ‘বাংলাদেশ ছাত্র আন্দোলন’, যুব সংগঠন ‘বাংলাদেশ যুব আন্দোলন’, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপের ছাত্র সংগঠন ‘বাংলাদেশ ছাত্র সমিতি’, যুব সংগঠন ‘বাংলাদেশ যুব সমিতি’র নেতাকর্মীরাও ধর্ষণবিরোধীসহ বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলনের নামে ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
তাদের বাইরে বামপাড়ার দুই বড় দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) এবং বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, খেলাঘর আসর, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রসহ (টিইউসি) বেশকিছু সংগঠন রাজপথে নানা ইস্যুতে এখন সরব।
এ প্রসঙ্গে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্সকে প্রশ্ন করা হলে তিনি আমার দেশকে বলেন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ প্রকৃত বাম আদর্শের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে অতীতে কখনো রাজনৈতিক ফায়দা লোটার সুযোগ দেয়নি। ভবিষ্যতেও দেবে না। বাম নামধারী তাদের সহযোগী কিছু দল ক্ষমতা লিপ্সায় এই সুযোগ দিতে পারে। আমরা আওয়ামী লীগের লুটপাট, দমনপীড়নের বিরুদ্ধে গত দেড় দশক রাজপথে থেকেছি। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনেও আমরা ছিলাম। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির ঘাড়ে আওয়ামী লীগের চড়ার বিষয়টি অবান্তর।
ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা ফজলে হোসেন বাদশা এবং সিপিবির মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমকে ফোন করে পাওয়া যায়নি। ১৪ দলের শরিক অনেক নেতাই এখন আন্ডারগ্রাউন্ডে।
সিপিবির রাজনীতিতে আওয়ামী আছড়
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সিপিবি ‘মস্কোপন্থি দল’ এবং আওয়ামী লীগের বি-টিম হিসেবে পরিচিত। সত্তরের দশকে রাজনৈতিক অঙ্গনে সিপিবি সম্পর্কে চমকপ্রদ স্লোগান ছিল তারা ‘মস্কোয় বৃষ্টি হলে ঢাকায় ছাতা ধরে’। ১৯৭৩ সালে সিপিবির দ্বিতীয় কংগ্রেসে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান অতিথি করেছিল দলটি। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের বাকশাল গঠনে সিপিবির ভূমিকার কথা রাজনৈতিক মহলে এখনো আলোচিত বিষয়। সিপিবি সভাপতি মনি সিংহ এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে সিপিবি এ কথা অস্বীকার করে। তবে সেদিন মনি সিংহ ও ফরহাদের নেতৃত্বে সিপিবি তার পুরো দলকে বাকশালে বিলুপ্ত করে দিয়েছিল। বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে এটি ছিল নজিরবিহীন ঘটনা। কারণ এর আগে কোনো কমিউনিস্ট পার্টি নিজের অস্তিত্ব বিলোপ করে অন্য দলে বিলীন হয়নি।
সিপিবি জিয়াউর রহমানের খাল কাটা কর্মসূচি ও ‘হ্যাঁ-না’ গণভোটে অংশ নিয়েছিল রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে। কিন্তু তাদের তৎপরতা ছিল খুবই সন্দেহজনক। জিয়াউর রহমানের চোখে এ তৎপরতা ধরা পড়ে যায়। তিনি তখন থেকে সিপিবিকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। কিছুদিনের মধ্যেই সিপিবির মুখোশ উন্মোচিত হয়। তারা আওয়ামী লীগকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং একই সঙ্গে ভারতের এজেন্ট হিসেবে তারা সব সময় এ দেশে কাজ করেছে। ফলে সিপিবিসহ বামপন্থি দল ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে স্লোগান উঠেছে রুশ-ভারতের দালালেরা হুঁশিয়ার সাবধান।
সিপিবির বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, যুবক এবং বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যাপারে মস্কোকেই প্রাধান্য দিয়েছে। জিয়াউর রহমানের সময় মুসলিম লীগসহ ইসলামপন্থি দলগুলো রাজনীতিতে পুনরুজ্জীবিত হলে সিপিবি এটাকে ভালো চোখে দেখেনি। সিপিবির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক কমরেড ফরহাদ নারায়ণগঞ্জের জনসভায় ‘বাংলাদেশে আফগান স্টাইলে বিপ্লব’ করার হুমকি দেন। এই হুমকি সরকার স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। এই হুমকির কারণে তৎকালীন সরকার কমরেড ফরহাদকে বিচারের মুখোমুখি করে। তখন সিপিবি কিছুদিনের জন্য আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায়। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় সিপিবি সক্রিয় ভূমিকায় ছিল। তবে আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তিতেই নিয়োজিত ছিল। প্রথমে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫ দলীয় জোটে ছিল। পরে ছিল পাঁচ দলীয় জোটে। এরশাদবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন সিপিবি আওয়ামী লীগের সঙ্গে আন্দোলন স্থগিত করে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে চলে যায় এবং নৌকা মার্কা প্রতীক নিয়ে ফরহাদসহ সিপিবির পাঁচজন এমপি নির্বাচিত হন। রাজনৈতিক অঙ্গনে সিপিবিকে তখন ব্যঙ্গ করে বলা হতো ‘নৌকা মার্কা কমিউনিস্ট পাটি।’ এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনেও তারা আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কায় নির্বাচন করে।
শেখ হাসিনার গত ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনামলে সিপিবি নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিল। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন হলেও সিপিবিকে সক্রিয় দেখা যায়নি। সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম চালাকির আশ্রয় নেন। তত্ত্ব দেন ‘আপদ ও বিপদ।’ সিপিবি থেকে ব্যাখ্যা করে বলা হয়, আওয়ামী লীগ হচ্ছে আপদ আর বিএনপি বিপদ। এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডকেই জায়েজ করে সিপিবি। জুলাই বিপ্লবে দুই হাজার ছাত্র-জনতা গুলিতে প্রাণ হারালেও আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সিপিবির জোরালো কোনো ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি। ছাত্ররা ঢাকাসহ সারা দেশে দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি অঙ্কন করে ফ্যাসিবাদের পুরো চিত্র দেশবাসীর সামনে তুলে ধরে। এক্ষেত্রে সিপিবির ছাত্র সংগঠনগুলোকে দেখা যায় তারা দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকছে এই বলে যে, ‘নৌকা আর ধানের শীষ, দুই সাপের একই বিষ।’ অর্থাৎ বিএনপিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে এক পাল্লায় দাঁড় করিয়ে কোণঠাসা করাই ছিল তাদের চালাকির অংশ।
বর্তমানে পরাজিত আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক অঙ্গনে ফিরে আসার জন্য নানামুখী ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। বিভিন্ন ইস্যুতে ইন্ধন দিচ্ছে। আওয়ামী লীগকে জায়গা করে দেওয়ার জন্য নেপথ্য থেকে চেষ্টা চালাচ্ছে সিপিবিসহ দলটির ছাত্র, যুব, শ্রমিক, পেশাজীবী ও নারী সংগঠনগুলো। ইমরান ও লাকীর সেই শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চকে জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা চালানো হচ্ছে। লাকী ছাত্র ইউনিয়নের সভানেত্রী ছিলেন। তেমনি সিপিবি সমর্থক বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ গত ১৫ বছরে চুপ মেরে থাকলেও এখন সরব ভূমিকায় নেমেছে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো রাজনৈতিক দল সিপিবি। সন্দ্বীপের অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বে ব্রিটিশ-ভারতের ১৯১৮ সালে প্রথম কমিউনিস্ট গ্রুপ গড়ে ওঠে। এর কিছু সময় পর ১৯২৫ সালে সর্বভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠে। সিপিবি হলো সেই পার্টির উত্তরাধিকার। কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস প্রায় শতবর্ষব্যাপী। বাংলাদেশে এই আন্দোলন কখনোই জনপ্রিয়তা পায়নি, যেমন পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও নেপালে। নেপালে কমিউনিস্ট পার্টি পরিণত হয়েছে মূলধারার রাজনৈতিক দলে।
গত দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে সিপিবি খুবই প্রান্তিক দল হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। পাকিস্তান আমলে প্রায় পুরোটা সময়ই নিষিদ্ধ অবস্থায় আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে গোপনে কাজ করতে হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টিকে। তখন সরকার ও ইসলামপন্থি দলগুলো কমিউনিস্ট পার্টির ‘নাস্তিক্যবাদী’ আদর্শকে শয়তানের আদর্শ হিসেবে প্রচার করতেন। ফলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মাঝে কমিউনিস্ট পার্টির কোনো ভিত্তি গড়ে ওঠেনি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সিপিবি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নাম ধারণ করে রাজনীতির সুযোগ পায়। ১৯৭৫ সালে বাকশালে বিলীন হয়ে যায় সিপিবি। তবে বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটিতে শুধু মনি সিংহকে একজন সদস্য হিসেবে রাখা হয়। ১৯৭৯ সালে সিপিবির তৃতীয় কংগ্রেসে বাকশালে যোগদানের সিদ্ধান্তকে ভুল ছিল বলে দলটি উল্লেখ করে। ১৯৮৬ সালে চতুর্থ কংগ্রেসে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক কমরেড ফরহাদ বলেন, ২০০০ সাল নাগাদ সিপিবির নেতৃত্বে বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হবে।
কিন্তু ফরহাদ কিংবা সিপিবি পরিষ্কার করে বলেনি বিপ্লব কীভাবে হবেন। তারা কি গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত করবেন, নাকি গেরিলা কায়দায় সশস্ত্র গৃহযুদ্ধ করবেন অথবা চারু মজুমদারের পথ ধরে গলা কাটার শ্রেণি শত্রু খতম বা ধনীদের হত্যা করবেন। তাদের এই বক্তব্য কথার কথা হিসেবেই থেকে যায়। রাজনীতিতে সিপিবি আওয়ামী লীগের ‘বি-টিম’ হিসেবেই কাজ করে।
১৯৯০ সালের দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ফলে মস্কোপন্থি দল হিসেবে সিপিবি সবচেয়ে সংকটে নিপতিত হয়। প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে সিপিবি সোভিয়েত ইউনিয়নের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব সিদ্ধান্ত ও কাজের প্রতি অন্ধ সমর্থন ব্যক্ত করে। স্ট্যালিন যখন ক্ষমতায়, তখন যেন স্ট্যালিনকে সমর্থন করেছে, আবার ক্রুসচেভ যখন স্ট্যালিনকে সমালোচনা করেন সেটিকেও তারা সমর্থন দিয়েছে।
ব্রেজনেভের সময় সিপিবি সব কাজ এমন কি আফগানিস্তানের অভিযান, প্রেসিডেন্ট হাফিজউল্লাহ আমীনকে হত্যা ইত্যাদি সমর্থন করেছে। তেমনি গর্ভাচেভের ‘খোলা হাওয়া’ (গ্লাসনস্ত) নীতির পক্ষে অন্ধভাবে দাঁড়িয়েছে। সোভিয়েত আমলে কেন্দ্র থেকে জেলা পর্যন্ত নেতাকর্মীদের নানা কর্মসূচিতে সোভিয়েতের পয়সায় ঘন ঘন সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপ সফর ছিল তাদের নিত্য ব্যাপার। অসুস্থ হলে সিপিবি এবং ন্যাপ (মোজাফফর) অনেক নেতা বিনা পয়সায় চিকিৎসা করাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা পূর্ব ইউরোপে যেতেন। পার্টির সমর্থকদের ছেলেমেয়েদের পড়তে তারা পাঠাতেন সেখানে।
সিপিবিতে কয়েক দফা ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। তৎকালীন সভাপতি সাইফউদ্দিন মানিক, সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম নাহিদ ও নূহ আলম লেলিন প্রমুখ সিপিবিকে ভেঙে রূপান্তরিত কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম দেন। সিপিবির দলীয় অফিস, সম্পত্তি এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বড় অংশ দখলে নেন। আবার কিছুদিন পর দল বিলুপ্ত করে গণফোরাম ও আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এভাবে সিপিবির পঞ্চম কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত হয়, পার্টি আর কখনো অন্য দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবে না। এখন দেখার বিষয় তারা কী করেন। সিপিবি সব সময়ই ভুল রাজনৈতিক লাইন নিয়েছে। ভারতের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে এবং আওয়ামী লীগ তোষণ করেছে।
ওয়ার্কার্স পার্টি ও মেননের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এখন কারাবন্দি। গত ২২ আগস্ট ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) গুলশানের বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে। নিউ মার্কেট থানার একটি হত্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এরপর তার বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের গণহত্যাসহ বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। ইতোমধ্যে তাকে কয়েক দফা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে।
এক সময় বাম রাজনীতির একেবারে প্রথম সারির নেতা ছিলেন মেনন। আদর্শিক পথে চলা মানুষ হিসেবে তখন তার পরিচিতি ছিল। কিন্তু সেই বাম নেতা মেনন হঠাৎ আলাউদ্দিনের চেরাগ হাতে পেয়ে যান। ভুলে যান তার আদর্শ, ভুলে যান তার দল ও নেতাকর্মীদের। আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার তোষণনীতি হয়ে ওঠে তার মূলনীতি। অভিযোগ রয়েছে, এর বিনিময়ে দুর্নীতিতে জড়িয়ে আয় করেন অঢেল সম্পদ। দলকে বিলীন করে দেন আওয়ামী লীগে। ওয়ার্কার্স পার্টি কয়েক দফা ভাঙনের সম্মুখীন হয়।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির রাজনৈতিক দল হিসেবে ১৯৮০ সালের দিকে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (লেলিনবাদী), বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ এবং অন্য একটি বাম গ্রুপ থেকে দলটির জন্ম। অমল সেন ছিলেন এ দলের প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব। ১৯৮৪ সালে দলটি দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। দুই গ্রুপই একই নাম ব্যবহার করে। একটির নেতৃত্ব দেন অমল সেন, অন্যটির নজরুল ইসলাম। ১৯৯২ সালে দলটি পুনরায় একত্রিত হয়। নেপথ্যে মূল নেতা হন রাশেদ খান মেনন। ছাত্র ইউনিয়নের এক সময়ের আলোচিত নেতা ছিলেন। পরে ছাত্রইউনিয়ন ভেঙে মেনন ও মতিয়া গ্রুপ হয়েছিল।
১৯৯২ সালের পর থেকেই মেননের ওয়ার্কার্স পার্টি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় মহাজোটের শরিক দল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। এদের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী, যুবমৈত্রী, জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন, জাতীয় কৃষক সমিতি, বাংলাদেশ ক্ষেতমজুর ইউনিয়ন, নারীমুক্তি সংসদ। মেননের ইশারাতেই চলে তাদের সব সংগঠন।
রাশেদ খান মেনন ১৯৭৯ সালে আদর্শিক বাম নেতা হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ ধারা অব্যাহত থাকে ১৯৯১ সালের নির্বাচনেও। তখন দেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। দলীয় কোন্দলের জেরে তোপখানা অফিসের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মরণাপন্ন অবস্থা হয়েছিল মেননের। তার চিকিৎসায় ঝাঁপিয়ে পড়েন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া।
তাকে বিদেশে পাঠানো হয় সরকারি খরচে। কিন্তু মেনন সুস্থ হওয়ার পর তার খেসারত দিতে হয়েছে খালেদা জিয়াকে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে আন্দোলনে একাট্টা হয়ে মেনন খালেদা জিয়াকে এক মুহূর্তের জন্যও শান্তিতে থাকতে দেননি। ২০০৮ সালে এসে রাশেদ খান মেনন পুরোপুরি বদলে যান। ১৪ দলীয় জোটের শরিক হিসেবে বলা যায় আওয়ামী লীগে বিলীন হয়ে যান। কাস্তে, হাতুড়ি ফেলে নৌকায় গিয়ে ওঠেন। ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪-এর নির্বাচন করেন নৌকা প্রতীকে। নির্বাচনের নামে প্রহসনের এই নির্বাচনগুলোর পক্ষে দাঁড়ান শেখ হাসিনার চেয়েও এক ডিগ্রি এগিয়ে গিয়ে। নির্বাচনগুলো সঠিক এই বয়ান দাঁড় করান জোরালোভাবে।
আওয়ামী লীগ তোষণে ওয়ার্কার্স পার্টি ও মেননের শ্রম সার্থক হয়। কারণ, শেখ হাসিনা মেননকে দু’বার মন্ত্রী বানান। একবার বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী এবং আরেকবার সমাজকল্যাণমন্ত্রী।
ঢাকা-৮ রমনা, মতিঝিল ও সবুজবাগ আসন থেকে ২০০৮ সালে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর ভিকারুন নিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিচালনা বোর্ডের সভাপতি হন তিনি। এ দায়িত্বে ছিলেন দীর্ঘ ৮ বছর। নৌকায় ওঠার পর থেকেই খাতা খোলেন দুর্নীতির। আর তার দুর্নীতির হাতেখড়ি হয় তিনটি স্কুলে ছাত্রভর্তি বাবদ বাণিজ্য দিয়ে। অভিযোগ রয়েছে প্রতিটি ভর্তিতে তিনি ও তার স্ত্রী লুৎফুন্নেসা খান ২ থেকে ৫ লাখ টাকা করে। ভর্তির পাশাপাশি ছিল নিয়োগবাণিজ্য। এ তিনটি স্কুলে শতাধিক লোককে শিক্ষক ও অন্যান্য পদে নিয়োগ দিয়েও বিপুল অঙ্কের টাকা কামিয়েছেন। তেমনি বিল-ভাউচার দেখিয়েও লোপাট করেছেন বিপুল টাকা।
২০১৯ সালের দিকে ওয়ার্কার্স পার্টির দশম কংগ্রেসকে সামনে রেখে দলে আরেক দফা ভাঙনের সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগ ও হাসিনা তোষণনীতি এবং শীর্ষ নেতৃত্ব মেনন ও অন্যদের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগে দলের ৬ নেতা কংগ্রেস বর্জনের ডাক দেন। এই ৬ নেতার পক্ষে তৎকালীন পলিটব্যুরোর সদস্য ইকবাল কবির জাহিদ মুখপাত্র হিসেবে গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে জানান, দল ও শীর্ষ নেতৃত্ব দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার পর আর এ দলে থাকা সম্ভব নয়।
একই প্রক্রিয়ায় যান দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বিমল বিশ্বাসও। তিনিও বলেন, চাওয়া-পাওয়ার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে ওয়ার্কার্স পার্টি, রাশেদ খান মেনন ও তার অনুসারী নেতারা। এর আগে দুই দফা ওয়ার্কার্স পার্টি ভেঙে গণফ্রন্ট নামে দল করেন টিপু বিশ্বাস এবং বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি করেন সাইফুল হক।
ওয়ার্কার্স পার্টি নেতা রাশেদ খান মেননের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ ওঠে যে, তিনি প্রতিবার নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে যে হলফনামা দেন তাতে সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। দেশে ও বিদেশে তার রয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ। কিন্তু সর্বশেষ নির্বাচনে ২০২৪ সালে হলফনামায় তিনি দেখিয়েছেন মাত্র ৩ কোটি ৪৬ লাখ ৭১ হাজার ২২৬ টাকা। দলকে ডুবিয়ে স্ত্রীকে সংরক্ষিত আসনের এমপিও বানিয়েছেন।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ শেখ হাসিনার পুরো ফ্যাসিবাদী শাসনকে তিনি সমর্থন দিয়ে গেছেন। এ সময়ে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে ভর্তি-বাণিজ্য, নিয়োগ-বাণিজ্য, ভিওআইপি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কমিশন-বাণিজ্য, মাদক ব্যবসা, স্বর্ণ চোরাচালান, চাঁদা আদায় বাবদ ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। ঢাকায় অসংখ্য ফ্ল্যাটের মালিক মেনন পরিবার। তেমনি ঢাকার বাইরে বিঘা বিঘা জমি রয়েছে তার। বিদেশেও তার সম্পদ থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) রাশেদ খান মেননের বেশকিছু অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে। দুদক মেননের অবৈধ সম্পদের প্রকাশ্য অনুসন্ধান শুরু করেছে।
রাশেদ খান মেনন ও ওয়ার্কার্স পার্টির সর্বশেষ ভূমিকাও ছিল ন্যক্কারজনক। মেননের সঙ্গে দলের নেতৃত্বে এখন রয়েছেন ফজলে হোসেন বাদশা। তিনিও নৌকা মার্কার এমপি ছিলেন। জুলাই বিপ্লবে ছাত্ররা যখন গুলিতে মারা যাচ্ছেন, মেননের ওয়ার্কার্স পার্টি গণভবনে ১৪ দলের বৈঠকে গিয়ে শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিবাদে এবং গণহত্যায় পূর্ণ সমর্থন দেন। তার বক্তব্য তখন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়।
জাসদ ও ইনুর কীর্তিকলাপ
জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও তার স্ত্রী আফরোজা হকের নামে জ্ঞাত আয়-বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে প্রায় ৫ কোটি টাকার জ্ঞাত আয়-বহির্ভূত সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
তার চারটি ব্যাংক হিসাবে প্রায় ১২০ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেন রয়েছে। আরেক মামলায় ইনুর স্ত্রী আফরোজা হকের বিরুদ্ধে প্রায় দেড় কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের অভিযোগ আনা হয়েছে। ইনুর উপার্জিত অর্থ দিয়ে তার স্ত্রী সম্পদশালী হয়েছেন। মামলাগুলো হয়েছে এ কারণে। বর্তমানে ইনু কারাগারে বন্দি রয়েছেন। জুলাই বিপ্লবের পর গত ২৬ আগস্ট উত্তরার একটি বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
হাসানুল হক ইনু ১৯৭২ সালে জাসদ প্রতিষ্ঠিত হলে এর সহ-সভাপতি হন। এর আগে ছিলেন জাতীয় কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক। ১৯৭৫ সালের ৫ নভেম্বরের বিপ্লবে সক্রিয় ছিলেন। তিনি কর্নেল (অব.) তাহেরের সহযোগী অর্থাৎ জাসদের গণবাহিনীর উপ-প্রধান ছিলেন। ১৯৮৬ সালে তিনি জাসদের সাধারণ সম্পাদক হন এবং ২০০২ সালে হন সভাপতি। ১৪ দলের শরিক হিসেবে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হন সেই সময় থেকেই।
২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে নৌকার প্রার্থী হিসেবে অবৈধ নির্বাচনগুলোতে নৌকা মার্কা নিয়ে কুষ্টিয়া-২ ভেড়ামারা-মিরপুর আসনের এমপি হন। ২০১৯ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার তথ্যমন্ত্রী হিসেবে ইনু জার্মানির হিটলারের তথ্যমন্ত্রী গোয়েবলসের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ইনুর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ইসলামবিদ্বেষ ছড়িয়ে দেন। তিনি শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সহায়তাকারী।
তার দল জাসদ ও অঙ্গ দলগুলোর নেতাকর্মী-সমর্থকরা নিজেদের বিলীন করে দেন শাহবাগের ফ্যাসিবাদে। ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের আলেমদের জঙ্গি আখ্যায়িত করে টানা প্রায় প্রতিদিনই জাতিকে জ্ঞান দেন তিনি। মাদরাসার বিরুদ্ধেও তিনি অবস্থান নেন। হেফাজতের প্রধান আল্লামা শফিকে তিনিই ‘তেতুল হুজুর’ আখ্যায়িত করেন।
শুধু তাই নয়, বিএনপি চেয়ারপার্সন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক জঘন্য বক্তব্য রাখেন তিনি। খালেদা জিয়ার গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার সংগ্রামকে তিনি ‘আগুন সন্ত্রাস’ হিসেবে নাম দেন।
খালেদা জিয়াকে ‘পাগলা গারদে’ পাঠানোর কথা বলেন তিনি। শেখ হাসিনার অবৈধ নির্বাচনের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে তিনি বক্তব্য দেন যে, খালেদা জিয়া নাকি কারাগার থেকে নাশকতার হুমকি দিয়েছেন। এমনও উক্তি করেন যে, খালেদা জিয়া নাকি তার ছেলে তারেক রহমানের কারণে রাজনীতির বাইরে চলে যাচ্ছেন। খালেদা জিয়াকে ‘জঙ্গিবাদের দুধমা’ বলেও জঘন্য বক্তব্য দেন তিনি।
ক্ষমতার প্রশ্নে জাসদ ২০১৬ সালে দু’ভাগ হয়। একটি অংশের অভিযোগ ছিল হাসানুল হক ইনু সরকারের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে সম্পদশালী হয়েছেন। কাউন্সিলে দলটা ভেঙে যায়। শরীফ নুরুল আম্বিয়া ও নাজমুল হক প্রধানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাসদ হয়। মশাল প্রতীক নিয়ে ইনুর জাসদ আলাদা থাকে। ইনু ইসির উপর চাপ সৃষ্টি করেন যাতে শরীফ নুরুল আম্বিয়ার জাসদকে নিবন্ধন না দেয়।
তবে তারা নিবন্ধন পেয়েছেন। ইনুর জাসদের সাধারণ সম্পাদক হন শিরীন আক্তার। তাকেও অবৈধ নির্বাচনে এমপি বানানো হয়। সংবিধানে ইসলামবিরোধী অনেক কিছু সংযোজন করার পেছনে জাসদের ইনু ও ওয়ার্কার্স পার্টির মেনন কাজ করেন।
একই সঙ্গে তারা জামায়াতে ইসলামের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে সোচ্চার ছিলেন। তেমনি বিএনপিকে পাকিস্তানপন্থী দল এবং মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানকে পাকিস্তানের চর হিসেবে উল্লেখ করতেন। জুলাই বিপ্লবে বিরোধিতার পাশাপাশি বিপ্লবী ছাত্র নেতাদের বিরুদ্ধে হুঙ্কারও দেন হাসানুল হক ইনু।