সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধানের বিদ্যমান প্রস্তাবনার বদলে নতুন প্রস্তাবনা রাখা এবং রাষ্ট্রের বাংলা নাম পরিবর্তনসহ নানা সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া ১৯৭২ সালের বিদ্যমান সংবিধান সম্পর্কে বলা হয়েছে, ফ্যাসিবাদের বীজ ’৭২ সালের সংবিধানের মধ্যেই নিহিত ছিল। আর নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে জরিপের ফল হিসেবে বলা হয়েছে, দেশের ৬৮.২৮ শতাংশ মানুষ নির্দলীয় রাষ্ট্রপতি এবং এ পদে সরাসরি ভোট চায়। গতকাল শনিবার নির্বাচনব্যবস্থা, সংবিধান, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ ও পুলিশ সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সংবিধানে প্রতিস্থাপনের জন্য সুপারিশ করা নতুন প্রস্তাবনাটি হচ্ছে, ‘আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, যারা এই ভূখণ্ডের মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে ঐতিহাসিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় জনযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছি এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছি; আমরা শহীদদের প্রাণোৎসর্গকে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে অঙ্গীকার করছি যে, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের যে আদর্শ বাংলাদেশের মানুষকে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে এবং গণতন্ত্র ও বৈষম্যহীনতার যে আদর্শ ২০২৪ সালে ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ করেছিল, সেই সব মহান আদর্শ রাষ্ট্র ও সমাজে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে; আমরা জনগণের সার্বভৌম অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্রকে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করে জনগণের জন্য একটি সংবিধান রচনা ও বিধিবদ্ধ করছি, যে সংবিধান বাংলাদেশের জনগণের সর্বোচ্চ আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ এবং যে সংবিধান স্বাধীন সত্তায় যৌথ জাতীয় বিকাশ সুনিশ্চিত করবে এবং বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকার সংরক্ষণ করবে; আমরা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করছি যে, এই সংবিধান প্রতিটি নাগরিককে পরস্পরের প্রতি অধিকার, কর্তব্য ও জবাবদিহির চেতনায় সংঘবদ্ধ করবে, সর্বদা রাষ্ট্র পরিচালনায় জনপ্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করবে, আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার নীতিকে অনুসরণ করবে এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব সমুন্নত রাখবে; জনগণের সম্মতি নিয়ে আমরা এই সংবিধান জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করছি।’
রাষ্ট্রের নাম সংশোধনে কমিশনের সুপারিশ, সংবিধানের প্রযোজ্য সব ক্ষেত্রে ‘প্রজাতন্ত্র’ এবং ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘নাগরিকতন্ত্র’ এবং ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দগুলো ব্যবহৃত হবে। তবে ইংরেজি সংস্করণে ‘রিপাবলিক’ ও ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ থাকবে।
নাগরিকতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা হবে ‘বাংলা’।
এ ছাড়া ১৯৭২ সালে রচিত সংবিধান বিষয়ে সমালোচকদের মতামত হিসেবে বলা হয়েছে, ‘১৯৭২ সালে একজন একক ব্যক্তি ও একটি দল কেন্দ্রে রেখে যে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত উত্তরোত্তর স্বৈরতন্ত্রী চেহারা ধারণ করতে করতে অবশেষে বাংলাদেশজুড়ে একটি ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করেছে।’ এ বিষয়ে আরো বলা হয়, “বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পরবর্তীকালের অগণতান্ত্রিক প্রবণতা ও শেষ পর্যন্ত ফ্যাসিবাদের বীজ ’৭২ সালের সংবিধানের মাঝেই নিহিত ছিল। এরই ফলাফল হলো প্রতিটি আমলেই ক্ষমতার পুঞ্জীভবন আরো ঘনীভূত হয়েছে, আমলাতান্ত্রিকতা আরো প্রকট রূপ পেয়েছে, বিচার বিভাগ ক্রমশ বেশি বেশি হারে দলীয়করণের শিকার হয়েছে, জবাবদিহির অভাবে ক্ষমতাসীনদের আর্থিক দুর্নীতি আরো প্রবল চেহারা নিয়েছে।”
পাঁচ খণ্ডের এই প্রতিবেদনের প্রথমেই রয়েছে ভূমিকা, পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশগুলোর সারসংক্ষেপ; যা এরই মধ্যে প্রকাশ করেছে সরকার। এটি তিন অধ্যায়ে সন্নিবেশিত করা হয়েছে।
প্রথম অধ্যায়ে রয়েছে বিদ্যমান সংবিধানের পর্যালোচনা, দ্বিতীয় অধ্যায়ে রয়েছে সুপারিশ ও তৃতীয় অধ্যায়ে রয়েছে সুপারিশের যৌক্তিকতা।
দ্বিতীয় খণ্ডে ১২১ দেশের সংবিধানের পর্যালোচনার ফল রাখা হয়েছে। তৃতীয় খণ্ডে রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটিসহ ব্যক্তির মতামতের সারাংশ রয়েছে। চতুর্থ খণ্ডে অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময়সভার কার্যাবহ এবং পঞ্চম খণ্ডে রাজনৈতিক দলগুলো থেকে সংবিধান সংস্কারের সুপারিশ রয়েছে।
কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তি জীবদ্দশায় সর্বোচ্চ দুবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পাবেন। প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদ হবে চার বছর করে। এ সময় তিনি রাজনৈতিক দলের প্রধান বা সংসদ নেতা হতে পারবেন না।
কমিশনের এই সুপারিশ প্রস্তুত করতে প্রায় এক লাখ মানুষের মতামত নেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়। কমিশনের সদস্যদের পাশাপাশি ৩২ জন গবেষক এ বিষয়ে কাজ করেছেন।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারে সুপারিশ : দেশের মানুষের ৬৮.২৮ শতাংশ নির্দলীয় রাষ্ট্রপতি চায়, আর এই পদে জনগণের সরাসরি ভোট চায় ৮২.৬৫ শতাংশ। এ ছাড়া সংসদ নির্বাচনে কোনো আসনে প্রদত্ত ভোট ৫০ শতাংশের কম হলে সেই আসনে পুনর্নির্বাচনের পক্ষে ৭৭.৭৯ শতাংশ এবং নির্বাচন কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পক্ষে ৪৬.৭৬ শতাংশ আর জেলা প্রশাসকদের নিয়োগ দেওয়ার পক্ষে ৪৪.০৪ শতাংশ মানুষ। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে জরিপে প্রাপ্ত এই ফলাফলের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। কমিশন বলেছে, গত ২০ থেকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই জরিপ চালানো হয়। কমিশনের পক্ষে জরিপটি পরিচালনা করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। এতে ৪৬ হাজার ৮০টি খানা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। জরিপে সংসদ নির্বাচনের আগে ৬৪.৯৭ শতাংশ মানুষ অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদের সময় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় বলে জানানো হয়। তবে নির্বাচন কমিশন আগেই জানিয়ে রেখেছে, তারা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কথা ভাবছে না।
এ ছাড়া এই সংস্কার কমিশন সংসদীয় এলাকার সীমানা নির্ধারণের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে প্রত্যাহার করে পৃথক একটি কমিশনের কাছে দিতে চায়। এ জন্য সংবিধান সংশোধন করে সীমানা নির্ধারণ কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সংসদীয় এলাকার সীমানা নির্ধারণ একটি জটিল ও সময়ক্ষেপণকারী বিষয়, যেখানে বিশেষায়িত জ্ঞান ও দক্ষতা প্রয়োজন। নির্বাচন কমিশনের এই কাজের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা আছে কি না তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। আর আগত নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য নির্বাচন কমিশনকে অনেক সময়-শ্রম দিতে হবে। তাই আমাদের আকাঙ্ক্ষা, সংসদীয় এলাকার সীমানা নির্ধারণের মতো কঠিন ও কষ্টসাধ্য কাজে সময় ব্যয় করার পরিবর্তে নির্বাচন কমিশন আসন্ন নির্বাচনের প্রস্তুতিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করুক। এ ছাড়া সংস্কার কমিশনের সুপারিশ, জনসংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে সীমানা নির্ধারণ করতে হবে।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কাজ যে কয়েকটি কারণে গতি পাচ্ছে না তার অন্যতম হচ্ছে সংসদীয় এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন সম্প্রতি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নির্বাচনী আইনের সংস্কার চূড়ান্ত না হওয়ার কারণে আমাদের অনেক কাজই শুরু হয়নি। এর মধ্যে রয়েছে নির্বাচনী এলাকাগুলোর সীমানা পুনর্নির্ধারণ। নির্বাচন কর্মকর্তারা মনে করছেন, জনসংখ্যাকে বিবেচনায় নিয়ে সীমানা পুনর্নির্ধারণ করতে হলে নির্বাচনী এলাকাগুলোর সীমানার ব্যাপক পরিবর্তন আসবে।’
সীমানা পুনর্নির্ধারণের বিষয়ে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ হচ্ছে : ১. আন্তর্জাতিক বেস্ট প্র্যাকটিস অনুযায়ী ভবিষ্যতে নির্বাচন কমিশনের পরিবর্তে একটি আলাদা সীমানা নির্ধারণ কমিশন গঠন করতে সংবিধান সংশোধন করা; ২. আলাদা কমিশন গঠন না করা পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের সহায়তায় একটি বিশেষায়িত কমিটি গঠন করা, যেখানে প্রয়োজনীয়সংখ্যক নির্বাচন কর্মকর্তা, ভূগোলবিদ, মানচিত্রকার, পরিসংখ্যানবিদ, নগর পরিকল্পনাবিদ, তথ্য-প্রযুক্তিবিদ, জনসংখ্যাবিদসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অন্তর্ভুক্ত হবেন। কমিশন এ কাজে দেশি ও বিদেশি যেকোনো ব্যক্তির বা সংস্থার সহায়তা নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে ক. পল্লী এলাকার ক্ষেত্রে ইউনিয়ন এবং সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার ক্ষেত্রে ওয়ার্ড কোনোভাবেই বিভক্ত না করা; খ. পার্বত্য এলাকার তিন জেলাকে তিনটি সুরক্ষিত সংসদীয় আসন হিসেবে বিবেচনা করা। অন্যান্য জেলায় যেখানে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বসবাস আছে সেগুলোতে ওই জাতিগোষ্ঠীকে বিভক্ত না করে অর্থাৎ একটি ইউনিট হিসেবে বিবেচনা করে একই সংসদীয় আসনের অন্তর্ভুক্ত করা; গ. মেহেরপুর, পিরোজপুরসহ ছোট জেলাগুলোর জনসংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে একটি আলাদা জনসংখ্যা কোটা বিবেচনা করে +/-১০%-এর বেশি বিচ্যুতি না করে ওই সব জেলার সীমানা নির্ধারণ করা। বৃহত্তর জেলার জনসংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে একটি আলাদা জনসংখ্যা কোটা বিবেচনা করে +/-১০%-এর বেশি বিচ্যুতি না করে ওই সব জেলার সীমানা নির্ধারণ করা। তবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রে এই বিচ্যুতি ২৫%-এর বেশি না করা।
কমিশন বলেছে, ‘আমাদের প্রস্তাবের একটি বড় যৌক্তিকতা হলো—নির্বাচন কমিশনকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা। কারণ আবারও যদি সংসদীয় এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ নিয়ে বড় ধরনের বিতর্ক হয়, যা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে, তাহলে জাতি হিসেবে আমরা একটি বড় অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হতে পারি, পুরো জাতিকে যার মাসুল দিতে হবে। এ ছাড়া অতীতের ন্যায় নির্বাচন কমিশন ভুল করলে, নাগরিকদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকবে না। কারণ সীমানা নির্ধারণ আইনে আদালতের আশ্রয় নেওয়ার ব্যাপারে বিধি-নিষেধ রয়েছে, যদিও তা নিরঙ্কুশ নয়। পক্ষান্তরে প্রস্তাবিত বিশেষায়িত কমিটি ভুল করলে নাগরিকরা নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রতিকারের জন্য যেতে পারবে।’
এর আগে এই সংস্কার কমিশনের যে প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছিল তাতে সীমানা নির্ধারণ সম্পর্কে আড়াই লাইনের একটি প্রস্তাব উল্লেখ ছিল।