শুক্রবার, ১১ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:৩৫ পূর্বাহ্ন

ধানমন্ডি ৩২ নম্বর গুঁড়িয়ে দিলেন ছাত্ররা

  • সময়: বৃহস্পতিবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫, ৮.৪১ এএম
  • ৫৮ জন

ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা ভারত থেকে দেওয়া ভার্চুয়ালি বক্তব্যের প্রতিবাদে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। বুধবার রাত সোয়া ১১টার দিকে ভবন ভাঙা শুরু হয়। সেখানে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা অবস্থান করছেন। তারা জানিয়েছেন, রাতের মধ্যেই ভবনটি ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবেন। এদিকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে শেখ মুজিুবের বাড়ি ছাড়াও ৫ নম্বর সড়কে শেখ হাসিনার বাসভবন সুধা সদনে আগুন দিয়েছে ছাত্র-জনতা। খুলনার ময়লাপোতা এলাকায় শেখবাড়ি নামে পরিচিতি শেখ হেলালের বাড়িতেও বুলডোজার দিয়ে ভাঙচুর করা হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেটসহ বিভিন্ন স্থানে শেখ মুজিবের মুর‌্যাল ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শেখ হাসিনার বক্তব্য দেওয়ার খবরে বিক্ষুব্ধ হয়ে ছাত্র-জনতাসন্ধ্যা থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে জড়ো হতে থাকেন। বিপুলসংখ্যক বিক্ষোভকারী গেট ভেঙে বাড়িতে ঢুকে এ বাড়িকে অভিশপ্ত আখ্যায়িত করে শাবল-হাতুড়ি দিয়ে ভাঙচুর শুরু করেন। এক পর্যায়ে বাড়িটির দোতলায় দেওয়া হয় আগুন। ৩২ নম্বরের বাড়ির পাশের একটি ভবনের এক পাশেও আগুন জ্বলতে দেখা যায়।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত দৈনিক আমার দেশ-এর স্টাফ রিপোর্টার ওয়াসিম সিদ্দিকী জানিয়েছেন, বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা রাতে ধানমন্ডিতে জড়ো হয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী নানা ধরনের স্লোগান দিয়ে ওই ভবনে প্রবেশ করে ভাঙচুর শুরু করেন। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িটি বাংলাদেশের জন্য অভিশাপ আখ্যা দিয়ে ওই বাড়িতে হাজার হাজার লোক জড়ো হয়। কয়েক হাজার মানুষ বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে বাড়িটি নিশ্চিহ্ন করার জন্য যে যার মতো অংশগ্রহণ করছেন।

অনেককে বলতে শোনা যায়, অন্তত একটি করে ইট হলেও নিয়ে স্মৃতি হিসেবে রেখে দিতে চান। কেউ কেউ এখান থেকে একটি লোহার গ্রিল, একটি কাঠের টুকরা, অর্থাৎ যে যার মতো যা পারছেন স্মৃতি হিসেবে আওয়ামী লীগের আঁতুড়ঘরখ্যাত ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে নিয়ে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকছেন।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাত সাড়ে ৮টার দিকে ঘটনাস্থলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা হয়। তারা শুক্রাবাদ সিগন্যালে অবস্থান নিলেও ঘটনাস্থলে যাননি।

রাত পৌনে ১১টার দিকে ভবন ভাঙতে বুলডোজার আনা হয়। বুলডোজরটি প্রথমে দেওয়াল ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে রাত ১১টা ১১ মিনিটে মূল ভবন ভাঙতে শুরু করে। এ সময় হাজার হাজার ছাত্র-জনতা স্লোগান এবং বিপুল করতালির মাধ্যমে উল্লাস প্রকাশ করতে থাকেন। স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে ওই এলাকা। ‘আজাদি না গোলামি, আজাদি আজাদ, ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা’, ‘ফ্যাসিবাদের আঁতুড়ঘর ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’—এরকম নানা স্লোগানের প্রকম্পিত হয়ে ওঠে ৩২ নম্বরের সড়কটি। স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে ওই এলাকা। একেকটি দেওয়াল ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসে ফেটে পড়ছিলেন তারা। রাত যত বাড়তে থাকে, দলে দলে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গা থেকে হাজার হাজার মানুষ ধানমন্ডি ৩২ নম্বর অভিশপ্ত বাড়ির সামনে এসে জড়ো হতে থাকে। যুবক, কিশোর, নারী-পুরুষসহ বয়স ধর্মবর্ণনির্বিশেষে রীতিমতো মানুষের ঢল নামে এ সড়কটিতে। ৩২ নম্বর সড়ক ছাপিয়ে মানুষের ঢল মিরপুর সড়ক পর্যন্ত পৌঁছায়।

ছাত্ররা জানিয়েছেন, তারা রাতেই ভবনটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবেন। ফ্যাসিবাদের তীর্থভূমি নিশ্চিহ্ন না করা পর্যন্ত তারা এই স্থান ত্যাগ করবেন না। রাতে সেখানে খাবার রান্নার প্রস্তুতি চলছে বলে জানা গেছে।

এদিকে রাত ৯টা ১০ মিনিটের দিকে সেনাবাহিনীর একটি টিম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে উত্তেজিত জনগণকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা ধানমন্ডি মিরপুর রোডের মূল সড়কে অবস্থান নেন। পরে রাত ৯টা ৫৮ মিনিটের দিকে তারা ওই এলাকা ছেড়ে চলে যান।

এদিকে মিরপুর রোড থেকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরমুখী সড়ক দিয়ে একটু পশ্চিম দিকে এগিয়ে গেলে বাম পাশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের ভিডিও প্রদর্শন করার ব্যবস্থা করা হয়। উৎসুক মানুষ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে শেখ হাসিনার সেই নির্মম গণহত্যার তাণ্ডবলীলা অবলোকন করেন। অনেককে সেখানে আবেগতাড়িত হয়ে যেতে দেখা যায়।

নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের আয়োজনে ছাত্রসমাজের উদ্দেশে শেখ হাসিনা রাত ৯টায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেবেন বলে সোশ্যাল মাধ্যমে প্রচারিত হয়। আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজেও এ তথ্যটি গত মঙ্গলবার প্রকাশ করা হয়েছে। এর প্রতিবাদে বুধবার রাত ৯টার দিকে ‘লং মার্চ টু ধানমন্ডি-৩২’ কর্মসূচির ঘোষণা দেয় জুলাই রেভল্যুশনারি অ্যালায়েন্স। এর আগে ফ্রান্সে অবস্থানরত লেখক ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্য ধানমন্ডি-৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাড়িতে লাখ লাখ মানুষকে যাওয়ার আহ্বান জানান। নিজের ফেসবুক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘কাডাল রানী লাইভে যাবে যখন, তখন সবাই যান ৩২ নম্বরে। বাকি কাম সাইরা আইসেন এইবার। লাখ লাখ মানুষ আসেন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে। আওয়াজ তোলেন থাকবে না, ৩২ নম্বর থাকবে না।’ এ আহ্বানের পর ‘ধানমন্ডির ৩২ নম্বর অভিমুখে বুলডোজার মিছিল’ নামে একটি কর্মসূচি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।

এদিকে ‘ধানমন্ডি ৩২ অভিমুখে বুলডোজার মিছিল’ শিরোনামে একটি পোস্টার ফেসবুকে পোস্ট করে বিদেশে অবস্থানরত সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেন লেখেন, আপার বক্তব্যের তালে তালে বুলডোজার চলবে।

এর প্রতি সমর্থন জানিয়ে স্ট্যাটাস দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা হাসনাত আবদুল্লাহও। সন্ধ্যায় কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে স্ট্যাটাসে লিখেন, ‘আজ রাতে ফ্যাসিবাদের তীর্থভূমি মুক্ত হবে।’

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৫ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছিল বিক্ষুব্ধ জনতা। এর পর থেকে বাড়িটি অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল।

ধানমন্ডির ৩২ নম্বর ছাড়াও শেখ হাসিনার মরহুম স্বামী ওয়াজেদ মিয়ার ধানমন্ডির বাসভবন সুধা সদনে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। ধানমন্ডি এলাকার ৫ নম্বর সড়কের বাড়িটিতে রাত পৌনে ১১টার দিকে আগুন দেয় বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে সুধা সদন পুরোপুরি খালি ছিল। এরপর খুলনার ময়লাপোতা এলাকায় অবস্থিত আলোচিত শেখ বাড়িতে শিক্ষার্থীরা প্রথমে ভাঙচুর করে। পরে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। বাড়িটি বাগেরহাট-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ হেলাল উদ্দিন ও খুলনা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েলের।

কুষ্টিয়া-৩ আসনের সাবেক এমপি ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফের বাড়ি ভাঙচুর ও এক্সকাভেটর মেশিন দিয়ে বাড়ির গেট ও বাড়ির দেওয়াল ভেঙে ফেলা হয়। রাত সাড়ে ৯টার দিকে বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা বাড়িটির সামনে আসে এবং মশাল জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করে।

সাতক্ষীরা জেলা শহরের খুলনা রোড মোড়ে জড়ো হয়ে শেখ মুজিবের ভাস্কর্য ভাঙচুর করে শিক্ষার্থীরা। জেলা পরিষদ চত্বর এবং সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের ম্যুরাল ভেঙে গুঁড়িয়ে দেন বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের নাম ফলক ভাঙচুর করে। পরে তারা হলের নাম পরিবর্তন করে ‘বিজয়-২৪’ নামকরণ করেন। এ ছাড়া ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল, নির্মাণাধীন শেখ হাসিনা হল, কামরুজ্জামান হল, শেখ রাসেল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে থাকা নামফলক ভেঙে ফেলেন। এ ছাড়া ক্যাম্পাস জুড়ে থাকা মুজিব পরিবারের নামে গ্রাফিতি ও দেওয়াল লিখন মুছে ফেলেন তারা।

সিলেটে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে স্থাপিত শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বুধবার রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা বুলডোজার নিয়ে ম্যুরালটি ভেঙে ফেলেন।

নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে শেখ হাসিনার বক্তৃতা প্রচারকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে মশাল মিছিল ও বিক্ষোভ করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা। পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও নগরের জামাল খান এলাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল ভাঙচুর করা হয়েছে।

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থাকা শেখ মুজিবের ম্যুরাল বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ও শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের নামফলক ভেঙে ফেলেছেন শিক্ষার্থীরা। এর আগে হাতুড়ি, রড, শাবল দিয়ে কারমাইকেল কলেজে থাকা বঙ্গবন্ধুর মুরাল ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পাবিপ্রবি) ছাত্রদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল এবং ছাত্রীদের শেখ হাসিনা হলের নামফলক ভেঙে দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। ময়মনসিংহ নগরের সার্কিট হাউস মাঠসংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল ভাঙচুর করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা।

এদিকে রাত ৯টায় ভার্চুয়ালি বক্তব্য দিয়ে পতিত ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনা ৩২ ধানমন্ডির ভবনের জন্য মায়াকান্না করেন। তিনি বলেন, যে স্মৃতি নিয়ে দুই বোন বেঁচে ছিলাম। আজকে সেই স্মৃতিটুকুও ভেঙে ফেলা হচ্ছে। এর আগে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। বাড়িটার কী অপরাধ। তবে একটা দালান ভাঙতে পারে ইতিহাস মুছে ফেলতে পারবে না। একবার ভাঙলে আবার আমরা গড়তে পারব। এ বাংলাদেশ আবারও মাথা তুলে দাঁড়াবে।

বরিশালে কালীবাড়ী রোডে শেখ মুজিবের ভাগনে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

আপনার সামাজিক মাধ্যমে খবরগুলো শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved by BUD News 24-2025
Developed BY www.budnews24.com