বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে ‘অথর্ব প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে মন্তব্য করেছেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। গত সোমবার রাজধানীতে অর্থনৈতিকবিষয়ক টাস্কফোর্সের সংবাদ সম্মেলনে এই মন্তব্য করেন তিনি।
টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বিমানকে ভেঙে দেওয়ারও সুপারিশ করা হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুরু থেকেই বিমানবাহিনী, সরকারি সচিব অথবা সামরিক বাহিনীর লোকেরা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পরিচালনার সঙ্গে ছিলেন। একই সঙ্গে এতে ছিল রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। নীতিনির্ধারণী পর্যায় কখনো কোনো অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞকে বিমানে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এর ফলে অথর্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে দেশের একমাত্র সরকারি এই আকাশ পরিবহন সংস্থা।
১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বিমান যাত্রা শুরু করে। ২০০৭-০৮ মেয়াদে ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিমানের ফ্লিটকে আধুনিকায়নের জন্য বোয়িংয়ের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। বিমানের বহরে যুক্ত হয় নতুন প্রজন্মের আধুনিক ১২টি বোয়িং উড়োজাহাজ।
সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর পুরস্কার স্বরূপ এয়ার মার্শাল (অব.) জামালউদ্দীনকে বিমানের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন। তিনি ছিলেন শেখ হাসিনার মিগ-২৯ মামলার সাক্ষী। তার মাধ্যমে বিমানের অর্থ লুটপাট ও লিজ বাণিজ্য শুরু হয়। এ সময় বিপুল পরিমাণ টাকা লুটপাট করে আওয়ামী লীগ সরকার।
২০১৪ সালে পাঁচ বছরের চুক্তিতে মিসরের ইজিপ্ট এয়ার থেকে বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর মডেলের দুটি প্লেন লিজ নেয় বিমান। বছর পার হতে না হতেই বিমান দুটির ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়ে। ওই ইঞ্জিনগুলো ছিল ১২-১৫ বছরের পুরোনো। ইজিপ্ট এয়ার থেকে ইঞ্জিন ভাড়ায় এনে সচল করা হয় একটি উড়োজাহাজ। অপরটিকে বসিয়ে রেখে লিজের টাকা পরিশোধ করতে হয় বিমানকে। দেড় বছরের মাথায় নষ্ট হয় সচল প্লেনটিও। এতে পাঁচ বছরে দেশের ক্ষতি হয় ১২০০ কোটি টাকা, যা একাদশ জাতীয় সংসদের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির তদন্তে ওঠে আসে।
জানা গেছে, ইজিপ্ট এয়ার থেকে লিজে আনা দুটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর-এর পেছনে বাংলাদেশ বিমানের গচ্চা যায় ৮৩৭ কোটি টাকা। ত্রুটিপূর্ণ চুক্তির কারণে রাষ্ট্রীয় সংস্থাটিকে বড় অঙ্কের এ অর্থ গুনতে হয়েছে। টাকার জোগান দিতে বিমান স্থানীয় ব্যাংকগুলোর কাছে লোনের জন্য আবেদন করে।
সংসদীয় কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চুক্তির সব শর্তই ইজিপ্ট এয়ারের পক্ষে। দুদক থেকে মামলাটির নথিপত্র কিছুদিন আগে বিমান থেকে নিয়ে গেছে।
হাসিনা সরকারের সময় সালমান এফ রহমান এয়ারবাস কেনার জন্য বিমানের পক্ষ থেকে দরকষাকষি করেন। কিন্তু বিষয়টি শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়নি।
বিমানের একজন পাইলট জানান, সরকারি সচিবরা টিকেট কাটেন ইকোনমি ক্লাসে অথচ ভ্রমণ করেন বিজনেস ক্লাসে। সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে বিমানের টিকিট বাবদ পাওনা কয়েক কোটি টাকা। বিমানের রুট প্ল্যানিং নিয়ে রয়েছে অদক্ষতা। বিমানের পরিচালনা পর্ষদের যারা মেম্বার তারাও অ্যাভিয়েশনে দক্ষ নন। এখন যারা টাস্কফোর্সের সদস্য এরাও তো একই মুখ, ঘুরে ফিরে। এরাই ঘুরে ফিরে বিমানের বোর্ড সদস্য, বিমানের পরিচালক আর মহাব্যবস্থাপক হয়ে বিমানে এসে পদ দখল করেন। এটাই হয়ে এসেছে আর এটাই এখনো হচ্ছে।
তিনি উল্লেখ করেন, ‘বিমানে দীর্ঘ বছর কাজ করে এটাই আমার সারমর্ম। বোর্ড মিটিংয়ে যখন বোর্ড মেম্বার প্রশ্ন করেন, বিমানের দুইটা ইঞ্জিন কেন আপনারা একসঙ্গে চালু রাখেন তখন নিজেকেই অথর্ব লাগত।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানের একজন সাধারণ কর্মচারী জানান, কর্মচারীরা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এখন চিন্তিত। কখন তাদের ওপর খড়গ নেমে আসে। তারা চান না বিমান বিভক্ত হোক। বরং দক্ষ লোক দিয়ে পরিচালিত হোক।