মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানের নেতৃত্বে একটি ‘কিলিং স্কোয়াড’ বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলীকে গুম করার পর হত্যা করে। হত্যার পর খুনিচক্র ইলিয়াস আলীর লাশ যমুনা নদীতে ফেলে দেয়। এই চাঞ্চল্যকর গুম ও হত্যার নির্দেশদাতা ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিতে র্যাব সদস্য সার্জেন্ট তাহেরুল ইসলাম ইলিয়াস আলীকে অপহরণের নির্মম ঘটনার বর্ণনা দিয়ে এ চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন। স্বীকারোক্তিতে তাহেরুল বলেন, জিয়াউল আহসানের নির্দেশে ঘটনার রাতে শেরাটন হোটেল থেকে তিনি ইলিয়াস আলীকে অনুসরণ করেন।
মহাখালী পৌঁছার পর জিয়াউল আহসান নিজেই আরেকটি টিম নিয়ে ইলিয়াস আলীর গাড়ি অনুসরণ করেন। ইলিয়াস আলীর গাড়ি বনানীর ২ নং সড়কের বাসার সামনে পৌঁছার আগেই বনানীর সাউথ পয়েন্ট স্কুলের সামনে থেকে তাকে তুলে নেওয়া হয়। ইলিয়াস আলীর সঙ্গে তার ড্রাইভার আনসারকেও অপহরণ করা হয়। গাড়িটি জলখাবার হোটেলের সামনে দিয়ে বনানীর ২ নম্বর সড়কে ঢোকার পরে এই অপহরণের ঘটনা ঘটে।
ট্রাইব্যুনাল সূত্র আরও জানায়, ইলিয়াসকে হত্যা ছাড়াও র্যাবের জিয়াউল আহসানের কিলিং স্কোয়াডের এক সদস্য একদিনে ১১ জন এবং আরেক সদস্য ১৩ জনকে খুন করেছিল। উল্লেখ্য, জিয়াউল আহসান তখন র্যাবে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তিনি জেলে আটক রয়েছেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও গুম তদন্ত কমিশন সূত্রে আরও জানা গেছে, ইলিয়াস আলীকে অপহরণের সঙ্গে জড়িত দুজন সেনাসদস্য বর্তমানে সেনাবাহিনীতে রয়েছেন। এরা হলেন ওয়ারেন্ট অফিসার জিয়া ও ইমরুল। জিয়াউল আহসানের রানার হিসেবে গুম ও খুন মিশনের হুকুম তারা তামিল করতেন। খুনিচক্রের সদস্য হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পর গুম তদন্ত কমিশন ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত টিমের সুপারিশের প্রেক্ষিতে সেনাবাহিনী এ দুই সদস্যকে ক্লোজড এবং অন্তরীণ করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।
শেরাটন থেকেই মোটরসাইকেলে অনুসরণ করছিলেন তাহেরুল
২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল সন্ধ্যার পর দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে ইলিয়াস আলী সভা করেন তৎকালীন শেরাটন হোটেলে (বর্তমান ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল)। সভা শেষ করে রাত ১১টায় তিনি বের হন এবং গাড়িতে করে বাসায় যাচ্ছিলেন। অপহরণের লক্ষ্যে জিয়াউলের নির্দেশে শেরাটন থেকেই অনুসরণ করছিলেন র্যাবের সদস্য সার্জেন্ট তাহেরুল ইসলাম। তাকে চিহ্নিত করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত টিম। তাকে তদন্ত কমিটিতে আনা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ১৬৪ ধারায় তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, আমার দায়িত্ব ছিল শেরাটন থেকে অনুসরণ এবং বেতার বার্তায় গতিপথ জিয়াউল স্যারকে জানানো। নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি ইলিয়াস আলীর গাড়ি অনুসরণ এবং প্রতিটি মুহূর্তে গাড়ির গতিপথ জিয়াকে অবহিত করা। মহাখালী পৌঁছার পর ইলিয়াস আলীর গাড়ি সরাসরি অনুসরণ শুরু করেন জিয়ার টিম।
মহাখালী জলখাবার হোটেলের অদূরে বনানীর ২ নম্বর সড়কে গাড়িকে ধাক্কা দিয়ে থামানোর পর ড্রাইভার আনসারসহ ইলিয়াস আলীকে অপহরণ করে এই টিমের সদস্যরা। এরপরই জিয়া তাহেরুলকে বলেন, ‘তোমার ডিউটি শেষ চলে যাও।’ নির্দেশনা অনুযায়ী দায়িত্ব শেষে তিনি ফিরে যান। জিয়ার টিম ইলিয়াস আলীকে নিয়ে যাওয়ার পর কী হয়েছে সেটা তিনি বলতে পারবেন না।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইলিয়াস আলীকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছিল। হত্যার পর তৎকালীন র্যাব কর্মকর্তা এবং পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীতে পদোন্নতি পেয়ে মেজর জেনারেল হওয়া জিয়াউল আহসান অফিসে ফিরে স্বস্তি ও আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আজ বড় একটি অপারেশনে সাকসেসফুল হলাম। শেষ করে তাকে যমুনায় ফেলে দিয়ে এসেছি।’
জিয়া এ কথাও বলেন যে, ইলিয়াস আলী অপারেশনের কথা ঊর্ধ্বতনকে জানিয়েছি। ঊর্ধ্বতন বলতে তিনি মেজর জেনারেল তারেক সিদ্দিকি কিংবা শেখ হাসিনাকে বুঝিয়েছেন বলে সূত্রের ধারণা। যাদের সামনে এই কথা জিয়াউল আহসান বলেছিলেন, তাদেরকেও চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত টিম।
এদিকে শেখ হাসিনার নির্দেশে বিভিন্ন ব্যক্তি ও রাজনৈতিক নেতাকে গুম এবং অপহরণের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে গুম তদন্ত কমিশন।
শেখ হাসিনার নির্দেশেই ইলিয়াস আলীকে গুম ও খুন
গুম তদন্ত কমিশন সূত্র জানায়, শেখ হাসিনার নির্দেশেই ইলিয়াস আলীকে গুম এবং খুন করা হয়েছিল। শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে এসএসএফ-এর মহাপরিচালক ছিলেন লে. জেনারেল চৌধুরী হাসান সওরাওয়ার্দী। তার সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, ডিজিএফআইর তৎকালীন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ডেকে নিয়ে ইলিয়াস আলীকে গুম করার নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। অথচ পরবর্তী সময়ে ইলিয়াস আলীর স্ত্রীকে ডেকে এনে নাটকও করেছিলেন।
পুরাতন শাড়ি পরে জড়িয়ে ধরেছিলেন ইলিয়াস আলীর স্ত্রী ও কন্যাকে। এ সময় ইলিয়াস আলীর স্ত্রীকে শেখ হাসিনা জানিয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশে অপহরণ করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরোধের জের হিসেবে এটা করা হয়েছে বলে ইলিয়াস আলীর স্ত্রীকে অবহিত করেছিলেন শেখ হাসিনা।
এদিকে গুম কমিশনের প্রাথমিক রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয়েছে অনেক গুমের ঘটনা শেখ হাসিনার নির্দেশে হয়েছিল। এই বিষয়ে ডিজিএফআই’র সাবেক একাধিক মহাপরিচালক গুম কমিশনের জিজ্ঞাসাবাদেও এ কথা স্বীকার করেছেন।
ইলিয়াস আলী গুমের তদন্ত করছে গুম কমিশন ও ট্রাইব্যুনাল
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইলিয়াস আলী ও ড্রাইভার আনসারকে গুমের বিষয়টি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্তের অধীনে রয়েছে। পাশাপাশি গুম কমিশনও তদন্ত করছে। সূত্র জানায়, ইলিয়াস আলী আর বেঁচে নেই তা অনেকটা নিশ্চিত। আগামী মার্চের শেষদিকে গুম তদন্ত কমিশন আরও একটি রিপোর্ট জমা দেবে সরকারকে।
গুম কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে কথা হয়েছিল এ প্রতিবেদকের। ইলিয়াস আলী প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ফিরে আসার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। ইলিয়াস আলীকে অপহরণের ক্লু পাওয়া গেছে এবং এ বিষয়ে আরও তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামের কাছে ইলিয়াস আলী প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তদন্ত অনেকদূর এগিয়ে গেছে। ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। পুরোপুরি তদন্ত শেষ হলে খোলাসা হওয়া যাবে।
গুমের পর প্রতিক্রিয়া ও গণভবনে তার পরিবার
ইলিয়াস আলীকে অপহরণের পর গুম করার প্রতিবাদে সারা দেশে বিক্ষোভ হয়। বিএনপি হরতাল ঘোষণা করলে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয় ইলিয়াস আলীকে ফেরতের দাবিতে। সিলেটে তুমুল বিক্ষোভ দমনে গুলিও চালিয়েছিল পুলিশ। পুলিশের গুলিতে বিশ্বনাথে ইলিয়াস আলীর নির্বাচনী এলাকায় ৭ জন নিহত হয়েছিলেন। তখনই আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ এক বক্তব্যে উপহাস করে বলেছিলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়ার শাড়ির আঁচলে ইলিয়াস আলী লুকিয়ে আছেন।’
এদিকে ঘটনার চারদিন পর র্যাব সদর দপ্তরের মোশতাক নামে এক কর্মকর্তা ইলিয়াস আলীর স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ফোন করে শোনান আশার বাণী। ওই র্যাব কর্মকর্তা জানান, আমাদের কাছে ইনফরমেশন আছে, উনাকে (ইলিয়াস আলী) পাওয়া যেতে পারে, আপনারা প্রিপারেশন রাখেন। এরপর ওই র্যাব কর্মকর্তা আরও একদিন ফোন করে একই কথা শোনান।
এর কিছুদিন পর ইলিয়াস আলীকে পাওয়ার আশার বেলুন ফুটো করে দেন ওই র্যাব কর্মকর্তা। তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে পরিবারের সদস্যদের জানান, যে ইনফরমেশনটা ছিল সেটা এখন আর নেই। এই বিষয়ে আর কিছু বলতে পারছেন না বলে জানিয়ে দেন।
কয়েকদিন পর জনৈক এক ব্যক্তি ফোন করে ইলিয়াস আলীর স্ত্রীকে জানান, ইলিয়াস আলী জীবিত আছেন। আপনি ইচ্ছে করলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেন। কীভাবে সাক্ষাৎ করা যায় সেটাও তিনি বলে দিলেন।
স্বামীর সন্ধান পেতে পরদিনই প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতের সুযোগ চেয়ে আবেদন করে পরিবার। অনুমতিও মেলে। দুই পুত্র ও শিশুকন্যাকে গণভবনে ডাকেন শেখ হাসিনা। তার সন্তানদের মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনাও দেন।
শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের কিছুদিন পর গাজীপুরের পুবাইল থেকে ইলিয়াস আলীর স্ত্রীর মোবাইলে আরও একটি ফোন আসে। এক নারী ফোন করে জানান, ইলিয়াস আলীকে পাওয়া যেতে পারে, দ্রুত পুবাইলে আসেন। বেশ কয়েকজন দলীয় নেতা ও র্যাব কর্মকর্তা মোশতাকসহ দ্রুত পুবাইলে যায় পরিবার। সেখানে যাওয়ার পর স্থানীয়রা জানান, একজন লোককে মাইক্রোবাসে করে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
এরপর তার স্ত্রীর কাছে আরও একটি উড়ো খবর আসে- মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্তে ইলিয়াস আলীকে ফিরে পাওয়া যেতে পারে। সেখানে র্যাব অভিযান চালায়। পরে ইলিয়াস আলীর পরিবার জানতে পারে, বিভ্রান্ত করতেই এমন খবর রটানো হয়।
শেখ হাসিনার নির্দেশে ইলিয়াস আলীকে প্রথমে অপহরণের পর গুম এবং খুনের পর র্যাব এভাবেই নাটক করে পরিবারের সঙ্গে।
স্বামীর সন্ধানের জন্য উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন স্ত্রী লুনা। একটি হেভিয়াস কর্পাস আবেদন দায়ের করে সন্ধান পেতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার অনুগত হাইকোর্ট তখন কোনো আদেশ দেয়নি।
উল্লেখ্য, ইলিয়াস আলী ও তার সঙ্গে ড্রাইভার আনসার আলীকে ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল বনানীর ২ নম্বর সড়কের সাউথ পয়েন্ট স্কুলের সামনে থেকে অপহরণ করা হয়। সেদিনই তিনি বিকালে সিলেট থেকে ফিরে দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে সাবেক শেরাটন ও বর্তমানে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে একটি বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন।
বৈঠক শেষে রাত ১১টার দিকে রওয়ানা হয়েছিলেন বনানীর বাসার দিকে। ইলিয়াস আলীর বাসার কাছাকাছি অবস্থান থেকেই তাকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদকের পাশাপাশি সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি ছিলেন তিনি।
সাবেক এই ছাত্রনেতার নেতৃত্বে ভারতের টিপাইমুখে বাঁধ দিয়ে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টির প্রতিবাদে তখন সিলেটে তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। ভারতের আসামে টিপাইমুখ এলাকায় বাঁধ দেওয়ার উদ্যোগ নিলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় সিলেটে। ক্ষোভে-বিক্ষোভে উত্থাল হয়ে ওঠে গোটা সিলেট। ইলিয়াস আলীর নেতৃত্বে তখন টিপাইমুখ বাঁধের প্রতিবাদে বিক্ষোভ, লংমার্চ ও হরতাল পালিত হয়েছিল।