সোমবার, ০৬ জানুয়ারী ২০২৫, ০৬:৩৪ অপরাহ্ন

প্রত্যক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন

  • সময়: শনিবার, ৪ জানুয়ারী, ২০২৫, ৮.৪৫ এএম
  • ৯ জন

রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে। দুই মেয়াদের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান এক ব্যক্তি হবেন না। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ হবে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে গঠনমূলক পরিবর্তন আনা হবে।

এমনসব বিধানের আলোকে সংবিধান সংস্কারের সুপারিশ করতে যাচ্ছে অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন সংবিধান সংস্কার কমিশন। গতকাল বন্ধের দিনেও সংস্কার কমিশনের বৈঠক হয়। কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী রীয়াজ আমার দেশকে জানান, সংবিধান সংস্কার বিষয়ে সুপারিশগুলো চূড়ান্ত করার জন্য তারা এখন শেষ পর্যালোচনায় রয়েছেন। এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দুই মেয়াদ টানা হবে, না মাঝে এক মেয়াদ বিরতি দিয়ে হবে। সে বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। রাষ্ট্রপতির প্রত্যক্ষ নির্বাচনের বিষয়ে আলোচনা হবে।

উল্লেখ্য, গত ৭ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করে। গঠনের সময়ে কমিশনের মেয়াদ ৯০ দিন করা হয়। সেটা আগামী ৭ জানুয়ারি শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে বৃহস্পতিবার সরকার এক প্রজ্ঞাপনে কমিশনের মেয়াদ আগামী ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছে।

কমিশন তার সুপারিশ তৈরির লক্ষ্যে ৯০ দিনের মেয়াদে ১২০টি দেশের সংবিধান পর্যালোচনা করেছে। এক্ষেত্রে কমিশন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, কোনো ব্যক্তির প্রতিকৃতি, মূলনীতি, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, রাষ্ট্র ধর্ম, এক কক্ষ, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট, সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে ইত্যাদি বিষয় কোন দেশের সংবিধানে আছে বা নেই তা জানার চেষ্টা করেছে। কমিশন ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মতামত নিয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মাধ্যমে সারাদেশে একটি জরিপও পরিচালনা করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর লিখিত মতামত গ্রহণ করেছে। এর বাইরে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও নানাভাবে অংশীজনদের মতামত নিয়েছে। রাষ্ট্রীয় স্পর্শকাতর ইস্যুতে বিভিন্ন ব্যক্তির মতামত গ্রহণের জন্য জরিপ চালিয়েছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এর বাইরে রাষ্ট্রের ১২০ জন সুশীলসমাজের নাগরিকের মতামত নিয়েছে কমিশন। অনলাইন জরিপে সাড়ে ৫৪ হাজার মতামত দিয়েছেন দেশের ও দেশের বাইরে থাকা বাংলাদেশি নাগরিকরা। সব পর্যালোচনা শেষে খসড়া প্রস্তাবনা চূড়ান্তকরণে কাজ করছে কমিশন বলে জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চার ক্ষেত্র তৈরি করা, একক নেতার আধিপত্য বিস্তারের ক্ষমতা খর্ব এবং ভবিষ্যৎ বিকল্প নেতা তৈরির জন্য সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনায় থাকছে সুপারিশ। সেখানে কোনো রাজনৈতিক দল জনভোটের ম্যান্ডেট নিয়ে সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে দলীয় প্রধান পদাধিকার বলে প্রধানমন্ত্রী হলে, তাকে ছাড়তে হবে দলীয় প্রধানের পদ। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীকালীন সময়ে তাকে দলের অন্য কোনো নেতার হাতে দলীয় প্রধানের দায়িত্ব দিতে হবে। দলীয় প্রধান চাইলে প্রধানমন্ত্রী না হয়ে দলের অন্য কাউকে দিতে পারবেন।

সংস্কার কমিশনের সার্বিক কার্যক্রম ও সুপারিশ নিয়ে শুক্রবার আমার দেশ পত্রিকার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. আলী রিয়াজ। সরকারপ্রধান হলে তিনি দলের প্রধান থাকতে পারবেন না- এমন কোনো সুপারিশ থাকছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে সংস্কার কমিশনপ্রধান বলেন, অংশীজনসহ অনেকে এ বিষয়ে সুপারিশ করেছেন। আমরাও বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা করেছি। একই সঙ্গে দলের প্রধান ও সরকারপ্রধান হলে ক্ষমতা এককেন্দ্রিক হয়ে যায়। অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতায় আমরা এককেন্দ্রিক ক্ষমতা থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। কাজেই দলের প্রধান ও সরকারপ্রধানের মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন হওয়া দরকার। কাজেই এ বিষয়টিকে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করছি।

একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুইবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন এমন সুপারিশ আসছে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে। তবে টানা দুইবার তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, নাকি ব্যক্তিজীবনে মোট দুইবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন- এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে এখনো কমিশন আসতে পারেনি বলে জানা গেছে। তবে টানা দুইবারের পরিবর্তে একাধিকক্রমে দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুপারিশ করার সম্ভাবনা বেশি বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে কমিশনপ্রধান বলেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অংশীজন থেকে এ বিষয়ে সুপারিশ ও পরামর্শ আমরা পেয়েছি। বিগত দিনের অভিজ্ঞতা হচ্ছে আমাদের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে। একই ব্যক্তি উপর্যুপরি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনে ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে কেন্দ্রীভুত হচ্ছে। আমাদের চিন্তা হলো ক্ষমতাকে এককেন্দ্রিকতা থেকে বের করে আনা। বাস্তব অভিজ্ঞতায় এটি হলে ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ নষ্ট হয়, জবাবদিহি কমে আসে এবং একপর্যায়ে জবাবদিহি তিরোহিত হয়। কাজেই এ বিষয়টি হয়তো আমাদের সুপারিশে থাকবে।

তবে একাধিকক্রমে দুইবার, না মোট দুইবার- এটা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আমরা এখনো আসিনি। আমরা বিষয়টি পর্যালোচনা করছি। আজও (৩ জানুয়ারি) বৈঠক করেছিলাম। রোববারও আমরা বৈঠক করব। দুটি বিষয়ের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক বিবেচনা করে যেটা তুলনামূলকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে সেটাই বিবেচনা করা হবে। যেহেতু বিষয়টি নিয়ে আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি, তাই এ মুহূর্তে স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারছি না। আমরা বিভিন্ন দেশের দৃষ্টান্তসহ সামগ্রিক দিক বিবেচনা করে যেটা সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য হয়, সেটা সুপারিশ করব।

সংস্কার কমিশন সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রপতি প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হলেও কমিশনপ্রধানসহ বেশির ভাগ সদস্যের ঝোঁক ওইদিকেই। তাদের অভিমত রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার একটি ভারসাম্য দরকার। আর এই ভারসাম্য নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা যেমন বৃদ্ধি প্রয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতিকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে বিদ্যমান জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে নির্বাচনের পদ্ধতি বাতিল করে প্রকৃত প্রত্যক্ষ ভোটের ব্যবস্থা করা দরকার।

বিদ্যমান সাংবিধানিক ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন দলের পছন্দনীয় ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে থাকেন। তাই রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার জন্য সংবিধান সংস্কার কমিশন নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করার সুপারিশ করতে যাচ্ছে। সেখানে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে দলনিরপেক্ষ ব্যক্তি হবেন রাষ্ট্রপতি- এ ধরনের বাস্তবসম্মত সুপারিশ করার জন্য খসড়া প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করা হচ্ছে।

জানা গেছে, সংবিধান সংস্কার কমিশন ছাড়াও নির্বাচনিব্যবস্থা সংস্কার কমিশনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তারা এ বিষয়ে নিজেরা কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশনের ওপর ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অবশ্য নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনও রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতা ভারসাম্যের কথা বলেছে।

রাষ্ট্রপতি প্রত্যক্ষ নির্বাচন ভোটে হবে কি না- এমন বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি বলে জানিয়েছেন আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, বিষয়টি আমাদের আলোচনার মধ্যে রয়েছে। এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারিনি। কমিশনের মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য নতুন করে আমরা তো কিছুটা সময় পেলাম। এর মধ্যে নিশ্চয়ই একটি সিদ্ধান্তে আসতে পারব।

সংস্কার কমিশনের মেয়াদ বৃদ্ধি প্রশ্নে- অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, আমরা সংবিধান পর্যালোচনা, অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা, সংলাপ জরিপ পরিচালনা ও লিখিত প্রস্তাবগুলোর আলোকে কাজের শেষ পর্যায়ে এসেছি। আমরা এখন লেখালেখির কাজটি করছি। আমাদের ওপর কাজের বেশ চাপ রয়েছে। নতুন করে সময় বৃদ্ধির ফলে আমাদের কাজটি আরও সহজতর হলো।

সংবিধানের বিদ্যমান ব্যবস্থায় ৭০ অনুচ্ছেদ এমপিদের দলের বিপক্ষে গেলে পদ হারাতে হয়। সংস্কার কমিশন এ বিধানকে স্বাধীন মতপ্রকাশের বিরোধী বলে মনে করছে। যে কারণে সংসদ সদস্যদের কথা বলার সুযোগ তৈরি করতে গঠনমূলক সংস্কারের সুপারিশ করছে। এক্ষেত্রে সংসদ গঠন এবং সংসদ ভাঙা- এই দুটি ক্ষেত্র ছাড়া অন্যসব বিষয়ে নিজ দলের বিপক্ষে অবস্থান নিতে পারবেন।

সংসদে সংসদ পরিচালনায় স্পিকারের একক ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার সুপারিশ করার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী ভিন্ন দলের থেকে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচনের বিধান করার সুপারিশ করার চিন্তাও করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর আদলে বাংলাদেশে সংসদও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করার সুপারিশ করবে কমিশন।

বর্তমানে সার্বভৌম সংসদের একক ক্ষমতা ভোগ করেন স্পিকার। স্পিকার যদি চান, তাহলে সংসদ পরিচালনায় ডেপুটি স্পিকার সংসদ পরিচালনার সুযোগ পান। আগামীতে সংসদ পরিচালনায় স্পিকারের একক ক্ষমতা হ্রাস করার সুপারিশ করা হতে পারে। স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার ক্ষমতাসীন দলের বাইরে রাখারও সুপারিশ করা হতে পারে- এমন আভাস দিয়েছে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সঙ্গে কাজ করা একাধিক ব্যক্তি।

জানা গেছে, কমিশন যেসব দেশের সংবিধান পর্যালোচনা করেছে তার মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ- উত্তর কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ভুটান, কাতার, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, কাজাখস্তান, কম্বোডিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, ইয়েমেন, মালয়েশিয়া, জাপান, চীন ও ফিলিপাইনসহ ৩২টি দেশে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র উল্লেখ নেই। তবে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম এ দুটি দেশে এ বিধান সংবিধানে রয়েছে। সংবিধানে জাতির পিতার স্বীকৃতি ভারত, চীন, জাপানে নেই। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। একই সঙ্গে কোনো ব্যক্তির প্রতিকৃতি বাংলাদেশ ছাড়াও আর কোনো দেশে আছে কি না- তার কোনো তথ্য পায়নি সংবিধান সংস্কার কমিশন।

তবে সংবিধানে সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস একেক দেশে একেক রকমের। যেমন- বাংলাদেশ, ইরান, আফগানিস্তান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সংবিধানে আল্লাহর নামে, সৃষ্টিকর্তার নামে শপথ রয়েছে পাঁচটি দেশে (ইরাক, ভারত, ইয়েমেন, কুয়েত ও কাতার), ওমান ও পাকিস্তানে সর্বশক্তিমান আল্লাহ, অস্ট্রেলিয়া ও ফিলিপাইনে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর, ইরান ও আফগানিস্তানের সংবিধানে আল্লাহর নামে শপথ নেওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে।

নথির তথ্য পর্যালোচনা ও কমিশন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপে জানা যায, সংবিধান সংশোধন করে জাতির পিতার স্বীকৃতি ও জাতির পিতার পরিবারের জন্য ভবিষ্যৎ সুরক্ষার সংশোধনী সন্নিবেশ করা হয়েছিল, সে সংক্রান্ত অনুচ্ছেদটি বাদ দেওয়ার সুপারিশ করার জন্য খসড়া চূড়ান্ত করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন।

আপনার সামাজিক মাধ্যমে খবরগুলো শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved © 2024
Developed BY www.budnews24.com