সোমবার, ০৬ জানুয়ারী ২০২৫, ০৫:৪১ অপরাহ্ন

চোরাই মাটিতে চলছে ঢাকার পাশের ৫০৪ অবৈধ ইটভাটা

  • সময়: শনিবার, ৪ জানুয়ারী, ২০২৫, ৩.৫৭ পিএম
  • ৮ জন

পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাব মতে দেশে মোট ৭ হাজার ৮৬টি ইটভাটা চালু রয়েছে। এর মধ্যে ৪ হাজার ৫৫০টির পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। যার মধ্যে ঢাকার আশপাশে ও জেলার কেরানীগঞ্জ, নবাবগঞ্জ, সাভার, ধামরাই, আশুলিয়া ও দোহার উপজেলায় আছে অনুমোদনহীন ৫০৪টি।

চলছে চোরাই মাটি ও সন্ত্রাসী পাহারায়। এরমধ্যে ঢাকার ধামরাই উপজেলায় ১৬৭, নবাবগঞ্জে ২০, দোহারে ১০, কেরানীগঞ্জে ১২০টি, আশুলিয়ায় ৭০, সাভারে ১১৭ ইটভাটার অনুমোদন নেই।

অনুসন্ধানে জানা যায়, অনুমোদনহীন ঢাকার আশপাশের এসব ইটভাটায় বছরে এক কোটি ২০ লাখ থেকে ১ কোটি ৫০ লাখ ইট তৈরি হয়। ইট তৈরির মাটি আসে চোরাইপথে সন্ত্রাসী পাহারায়। মাটির সিন্ডিকেট স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় রাতের অন্ধকারে ফসলি জমির টপসয়েল কেটে বিক্রি করছে ইটের ভাটায়।

কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়া ইউনিয়নের রাজেন্দ্রপুর ও রাজ হালট এলাকায় এক কিলোমিটারের মধ্যে এআরবি এআরবিএম আইবিএমসহ ৯টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে এআরবিএম এআরবিসহ চারটি ইটভাটা তেঘরিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত জজ মিয়া পরিবারের।

আইবিএম কোম্পানির তিনটি ইটভাটার মালিক বর্তমান চেয়ারম্যান ও আ. লীগ উপজেলা কমিটির সদস্য লাটমিয়ার। গত তিন বছরে লাটমিয়ার দুটি ইটভাটায় একাধিকবার পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে কার্যক্রম বন্ধ করে দিলেও কিছুদিন পর আবার সেগুলো চালু হয়ে যায়। লাট মিয়া পরিবারের নয়টি ইটভাটার পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। ইটভাটাগুলোর আশপাশে রয়েছে ফসলি জমি স্কুল, মসজিদ, মাদরাসা ও আবাসিক ভবন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর লাট মিয়া একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতাকে ম্যানেজ করে ইটভাটাগুলো চালাচ্ছেন।

নিয়ম অনুযায়ী কোনো ইটভটা ১২০ ফুট চিমনিবিশিষ্ট সনাতন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারবেন না মর্মে নির্দেশনা থাকলেও প্রভাবশালী লাট মিয়া এ নির্দেশনা মানছেন না। একই অবস্থা উপজেলার কোনডা ইউনিয়নে। এখানকার আ. লীগ নেতা রাসেল মেম্বারসহ অর্ধশত ব্যক্তির শতাধিক ইটভাটা রয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর মুন্সীগঞ্জ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, মুন্সীগঞ্জ জেলার ৪ উপজেলায় ৫৮টি অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়, থানা পুলিশ, উপজেলা প্রশাসন এবং ডিসি অফিসের অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে অনুমোদনহীন ইটভাটাগুলো চলছে।

ধামরাই উপজেলা প্রশাসন ও ইটভাটা মালিক সমিতি সূত্রে জানা যায়, এখানে ১৬৭টি ইটভাটা রয়েছে যার মধ্যে ৭১টি অনুমোদনহীন। বাকিগুলোর ইউনিয়ন পরিষদের ট্রেড লাইসেন্স থাকলেও পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। প্রতিবছর ৩০ লাখ টন মাটি যায় ধামরাইয়ের ইটভাটাগুলোতে।

সাভারে ১৫৪টি ইটভাটা রয়েছে। এর বাইরে আশুলিয়ায় রয়েছে ৭০টি। সব মিলে এ উপজেলায় ইটভাটা রয়েছে ২২৪টি। দোহার ও নবাবগঞ্জে রয়েছে আরও ৩০টি অনুমোদনহীন ইটভাটা।

কেরানীগঞ্জের জাজিরা এলাকার নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ইটভাটার মালিক বলেন, ইটভাটার অনুমোদন নিতে পরিবেশ ছাড়পত্র লাগে, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে লাইসেন্স নিতে হয়। তাছাড়া ২ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো স্কুল-কলেজ, মাদরাসা, জনবসতি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলে উক্ত এলাকায় ইটভাটার অনুমোদন দেওয়া হয় না।

এখানকার বেশিরভাগ ইটভাটা জনবসতি এলাকা হওয়ায় জেলা প্রশাসনের কোনো অনুমোদন নেই। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থানা পুলিশ ম্যানেজ করে চলছে। ইটভাটার টাকা যায় স্থানীয় পাতি নেতা থেকে শুরু করে প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতা পর্যন্ত।

ইটভাটায় পোড়ানো হয় কাঠ। তবে ইদানিং কাঠের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় পুরোনো প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্য এবং নষ্ট বৈদ্যুতিক তাঁরের প্লাস্টিকও পোড়ানো হয়। ইটভাটায় মাটি আনা হয় দুই ফসলি, তিন ফসলি জমি থেকে।

তিনি বলেন, ফসলি জমির মাটি কেটে নেওয়া হয় ভেকুর মাধ্যমে ট্রাক দিয়ে। প্রতি ট্রাক মাটি বিক্রি হয় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। অন্যদিকে নদীর তীরবর্তী ফসলি জমির মাটি কেটে নেওয়া হয় ইঞ্জিনচালিত ট্রলার বা বোটের মাধ্যমে । প্রতি বোট মাটি বিক্রি হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। কেরানীগঞ্জে বাঘৈর মৌজায় রাতের অন্ধকারে তিন ফসলি জমির মাটি কেটে নেওয়ায় উপজেলা প্রশাসন, ঢাকা জেলা প্রশাসক, সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে অভিযোগ করেও মাটিকাটা ফেরাতে পারেনি জমির মালিক শাহাদাত হোসেন।

তিনি বলেন, কেরানীগঞ্জের দুটি থানায় অর্ধশত মাটি চুরির অভিযোগ রয়েছে। পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এ ব্যাপারে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ হলে তিনি মাটি চুরির অভিযোগের কথা স্বীকার করে বলেন, থানায় অভিযোগ করার পরে অভিযোগকারীরা আর যোগাযোগ করেনি।

ঢাকা জেলা প্রশাসকের ব্যবসা ও বিনিয়োগ শাখার কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন বলেন, পরিবেশের ছাড়পত্র দিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ইটভাটার অনুমোদন নিতে হয়। ছাড়পত্র ছাড়া অনুমোদন দেওয়া হয় না। এনডিসি ডেভলপমেন্টকে আহ্বায়ক করে ইটভাটা নিয়ন্ত্রণের কমিটি রয়েছে। এ কমিটির যাচাই-বাছাইয়ের পর কাগজপত্র ঠিক থাকলে অনুমোদন দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ ব্রিক মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোনায়েম খান রাজা ইটভাটায় চাঁদাবাজির কথা স্বীকার করে বলেন, স্থানীয় রাজনৈতিক দলের পাতি নেতা থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নেতা পর্যন্ত ব্রিক ফিল্ডের মালিকদের চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা দিতে হয় থানা পুলিশকে। পুলিশের ক্যাশিয়ার থানার ওসি, তদন্ত অফিসার, দারোগা থেকে শুরু করে পুলিশ সুপারের নামে ব্রিকফিল্ড থেকে চাঁদা আদায় করা হয়। চাঁদা আদায় করে গোয়েন্দা বিভাগের সদস্যসহ পরিবেশ অধিদপ্তরের নামে বিভিন্ন সংস্থা।

আপনার সামাজিক মাধ্যমে খবরগুলো শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved © 2024
Developed BY www.budnews24.com