বৃহস্পতিবার, ০২ জানুয়ারী ২০২৫, ১১:১০ অপরাহ্ন

কবরস্থ হচ্ছে ৭২’র সংবিধান

  • সময়: সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১০.০৪ এএম
  • ১০ জন

বৈষম্যহীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা সামনে রেখে প্রকাশ পেতে যাচ্ছে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র। লাখো ছাত্র-জনতার উপস্থিতিতে ৩১ ডিসেম্বর রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে এটি প্রকাশ করা হবে। ছাত্রনেতারা বলছেন, জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের রক্ত দিয়ে পুরোনো ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করবে তরুণ ছাত্র-জনতা। জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের মাধ্যমেই প্রতিফলন হবে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার। এর মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে মুজিববাদী ৭২’র সংবিধানের কবর রচিত হবে।

৩১ ডিসেম্বর রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র প্রকাশ করবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। ওইদিন বিকাল ৩টায় লাখো ছাত্র-জনতার উপস্থিতিতে ঘোষণাপত্র প্রকাশ করবেন তারা। বিষয়টি রোববার দুপুরে রাজধানীর বাংলামোটরে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। সেখানে সংগঠনটির আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আমরা চাই, মুজিববাদী সংবিধানকে কবরস্থ ঘোষণা করা হবে। যেখান থেকে (শহিদ মিনার) একদফার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, ঠিক সেই জায়গা থেকে মুজিববাদী বাহাত্তরের সংবিধানের কবর রচিত হবে। আমরা প্রত্যাশা রাখছি, জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রে নাৎসিবাদী আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশে অপ্রাসঙ্গিক ঘোষণা করা হবে।

প্রসঙ্গত, লাখো ছাত্র-জনতার উপস্থিতিতে ৩ আগস্ট বাংলাদেশের নতুন ইতিহাস রচিত হয় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে। সেদিন গণহত্যার বিচারের দাবিতে গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয় কোটাবিরোধী আন্দোলন। ওইদিন ঘোষণা করা হয় ফ্যাসিবাদ শেখ হাসিনাকে হটানোর একদফা। এরপর ৫ আগস্ট আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। আত্মগোপনে চলে যান তার সরকারের প্রভাবশালী এমপি-মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মী। এরপর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৮ আগস্ট শপথ নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সরকার গঠনের ১৪৫ দিনের মাথায় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার থেকে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র দিতে যাচ্ছেন ছাত্রনেতারা।

সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আমাদের অভ্যুত্থান বিপ্লবের যে ঘোষণাপত্র, সেটি ৫ আগস্টে হওয়া উচিত ছিল। এটি না হওয়ার কারণে ফ্যাসিবাদের পক্ষের শক্তিগুলো মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী পাড়া-সব জায়গায় আমরা যাদের উৎখাত করেছি, বিদেশে বসে তারা ষড়যন্ত্র করেই যাচ্ছে। এটা একধরনের বৈধতাকে প্রশ্ন তুলছে। ২ হাজার শহিদ এবং ২০ হাজারের বেশি আহতের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে তারা এই অভ্যুত্থানের বৈধতাকে প্রশ্ন করছে।

তিনি বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মানুষ ৭২’র মুজিববাদী সংবিধানের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। এই যে মানুষের বিপরীত অবস্থান, এটির একটি আইনগত নথি থাকা উচিত। সেই জায়গা থেকে আমরা ৩১ ডিসেম্বর বিকাল ৩টায় ছাত্র-জনতার উপস্থিতিতে গণ-অভ্যুত্থানকে ঘিরে যে গণ-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে এবং ৭২’র সংবিধানের বিপরীতে গিয়ে মানুষ যে রাস্তায় নেমে গিয়েছে, সেটির প্রাতিষ্ঠানিক ও দালিলিক স্বীকৃতি ঘোষণা করব। হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, এ ‘প্রোক্লেমেশন অব জুলাই রেভুলেশন’-এর পরবর্তী বাংলাদেশের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, অভিপ্রায়, লক্ষ্য এবং ইশতেহার লিপিবদ্ধ থাকবে। এটি কোনো দলের না, কোনো শ্রেণির না। আমাদের স্বপ্নগুলো ঐতিহাসিক বিভিন্ন স্তরে বঞ্চিত হয়েছে। আমরা প্রতারিত হয়েছি। এই প্রোক্লেমেশন অব জুলাই রেভুলেশনের মধ্য দিয়ে আর যেন বঞ্চিত না থাকে। গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনের ইশতেহার জাতির সামনে ঘোষণা করা হবে। বিপ্লবের ঘোষণাপত্রে ‘নাৎসিবাদী আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশে অপ্রাসঙ্গিক ঘোষণা করা হবে।

জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক ও জুলাই শহিদস্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম বলেন, আমরা বিপ্লবের একটিমাত্র ধাপ অতিক্রম করেছি। জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র আরও আগে ঘোষণা করা প্রয়োজন ছিল। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের এ বিপ্লব যেমন ফ্যাসিস্টবিরোধী সবাইকে ধারণ করতে পেরেছিল, এ ঘোষণাপত্রও সবার আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে পারবে।

ঘোষণাপত্রের একটি খসড়া করা হয়েছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, এ বিপ্লবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল-মত, ধর্ম ও বয়সের যে মানুষেরা সরাসরি অংশ নিয়েছেন-বিভিন্ন জায়গা থেকে তাদের মতামত নেওয়া হচ্ছে। এটি সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করা হচ্ছে।

সারজিস আলম বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি-কোনোটিই রাজনৈতিক দল হবে না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জুলাই বিপ্লবের ঐক্যের প্রতীক, ইউনিক একটা প্ল্যাটফরম, এটা আমাদের ইউনিটির সিম্বল হিসাবে থাকবে। কখনো রাজনৈতিক দল হবে না। নতুন রাজনৈতিক দল অবশ্যই অন্য কোনো নামে হবে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আবদুল হান্নান মাসউদ বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আমরা জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র ঘোষণা করব। সেটা সংবিধানে যুক্ত করে সেকেন্ড রিপাবলিক করার দায়িত্ব সরকারের।

ঘোষণাপত্রের খসড়া : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সমন্বয়ে প্রস্তুত করা জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের প্রাথমিক খসড়ায় উল্লেখ করা হয়-পাকিস্তান এই ভূমির মানুষের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে এবং লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে। এই ভূমির মানুষ পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে গৌরবময় ’৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। কিন্তু ’৭২ সালের সংবিধান লাখ লাখ শহিদের স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে গণতন্ত্র ও জাতীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতার পথ প্রশস্ত করেছে। সামরিক আইন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সংবিধান সংশোধনী রাষ্ট্রকে দুর্বল এবং এর প্রতিষ্ঠানগুলোকে অরক্ষিত করেছে। এ অশান্ত যাত্রার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, জবাবদিহিতা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিষ্ঠান এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের যন্ত্র হিসাবে ব্যর্থতা কুখ্যাত ১/১১ বন্দোবস্তে বড় ভূমিকা পালন করেছে। এক-এগারো নীতিমালা বাংলাদেশে মুজিববাদী ধারা স্থায়ী করেছে এবং শেখ হাসিনার প্রশ্নাতীত ক্ষমতা ও আধিপত্যের পথ সুগম করেছে। উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও প্রতিশ্রুতিগুলো ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের পূজার জন্য অস্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে।

খসড়ায় আরও বলা হয়, সামরিক প্রতিষ্ঠান, বিচার বিভাগ, বেসামরিক প্রশাসন এবং পুলিশ প্রশাসন রাজনীতিকরণ, দুর্নীতি এবং পঙ্গুত্বের শিকার হয়ে দমনমূলক ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। ১৫ বছর ধরে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং ভিন্নমত দমন করা হয়েছে। পিলখানা, শাপলা হত্যাকাণ্ড এবং প্রহসনের বিচারিক হত্যাকাণ্ড রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে সংঘটিত হয়েছে। ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এবং সরকারি কর্মকর্তারা শেখ পরিবার ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে মিলে রাষ্ট্রের বিপুল সম্পদ আত্মসাৎ করেছেন। পরপর তিনটি নির্বাচন অবৈধ ও দুর্নীতিপূর্ণভাবে পরিচালিত হয়েছে এবং জনগণ তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

খসড়া তালিকায় উল্লেখ করা হয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং ফ্যাসিস্ট অপরাধীরা হাজার হাজার নিরস্ত্র শিক্ষার্থীকে হত্যা করেছে। শিক্ষার্থীরা অনির্বাচিত এবং অবৈধ শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবি নিয়ে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। এই অহিংস আন্দোলনকে নির্মমভাবে দমন করা হয়েছে। বাংলাদেশে ছাত্র-জনতা সর্বজনীন সমর্থন পেয়েছে এবং এভাবে আমরা হাজারেরও বেশি প্রাণের আত্মত্যাগ করেছি। আমরা নিজেদের স্বাধীন জনগণ হিসাবে ঘোষণা করছি মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুতি-মর্যাদা, সাম্য, ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে।

জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের খসড়ায় শেখ হাসিনার শাসনাধীন সব মনোনীত বা নির্বাচিত অফিসের বিলুপ্তি, ’৭২ সালের সংবিধানের সংস্কার বা বাতিল ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং সংবিধানের পুনর্গঠনের দাবি করা হয়। এছাড়া বাংলাদেশের শিক্ষার্থী এবং জনগণ, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চায়। যেটি গঠিত হবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের দ্বারা।

আপনার সামাজিক মাধ্যমে খবরগুলো শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved © 2024
Developed BY www.budnews24.com