রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:২৯ পূর্বাহ্ন

বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ অন্তবর্তী সরকার

  • সময়: শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২.০৩ পিএম
  • ৫ জন

নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ ঠিকভাবে করতে পারছে না অন্তর্বর্তী সরকার। চাল, ডাল, চিনি, তেল, আলু, ডিমসহ সব পণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। গত এক মাসে দাম বেড়েছে আরেক দফা। ধারাবাহিক মূল্যবৃদ্ধি রোধে সরকার পণ্য আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহার করে নিলেও, এর সুফল পাচ্ছেন না ক্রেতারা। বিক্রেতারা বলছেন, বাজারে পণ্যের ঘাটতি নেই, তবে পাইকারি পর্যায়ে দাম বেশি থাকায় খুচরা বাজারে চড়া মূল্যে নিত্যপণ্য বিক্রি হচ্ছে।

বাজার নিয়ন্ত্রণে এই ব্যর্থতার দায় কার, জানতে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব সেলিম উদ্দিনের বক্তব্য জানার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। বাণিজ্য সচিবের কাছে লিখিতভাবে এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চেয়েছিল আমার দেশ। কিন্তু তিনি কোনো জবাব দেননি। তবে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে মূল্যস্ফীতির কথা স্বীকার করেছেন। তিনি আমার দেশকে জানিয়েছেন, শিগগিরই পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে এবং টিসিবির পণ্য বিক্রিতে শৃঙ্খলা না ফিরিয়ে শুধু শুল্ক কমালে জনদুর্ভোগ কমবে না। উল্টো রাজস্ব আয় কমে যাবে। বাজার বিশ্লেষকরা আরও মনে করেন, সামনে রমজান মাস। এ মাসে ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার জন্য ওত পেতে থাকেন। সরকারকে এ বিষয়ে সর্বোচ্চ নজর দিতে হবে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকের পাশাপাশি বাজার নিয়ন্ত্রণে বিশেষ টাস্কফোর্স পরিচালনায় আরও কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। ব্যবসায়ীদের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকলে, সেগুলো দূর করে দিতে হবে। তেমনি বাজারে যাতে পণ্যের সংকট না হয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। টিসিবির মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিতে হবে। টিসিবির পণ্য বিক্রিতে যে বিশৃঙ্খলা দেখা যাচ্ছে, তা নিরসন করতে হবে।

সরেজমিনে বাজারমূল্য : গতকাল সরেজমিনে রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি মোটা চাল (স্বর্ণা ও চায়না ইরি) বিক্রি হচ্ছে ৫২ টাকা দরে। সরু চাল নাজির ও মিনিকেটের দাম ৬৯ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত। আলুর দাম ৫৫ থেকে ৫৭ টাকা কেজি। খোলা আটা বিক্রি হচ্ছে ৪২ টাকা কেজি দরে। প্যাকেট আটা ৫৫ টাকা। খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৬৫ টাকা লিটার। দেশি মসুর ডাল ১৩৫ টাকা কেজি ও তুরস্ক থেকে আমদানি করা ডাল বিক্রি হচ্ছে ১০৭ টাকা কেজি। চিনি বিক্রি হচ্ছে ১২৭ টাকা কেজি দরে। তবে খোলাবাজারে চিনির দাম ১২৪ টাকা। ব্রয়লার মুরগি, হলুদসহ কয়েকটি পণ্যের দামেও চলছে অস্থিরতা। এক মাসে আমদানি করা হলুদের দাম পাঁচ ভাগ পর্যন্ত বেড়েছে বলে জানিয়েছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)।

টিসিবির দেওয়া বৃহস্পতিবারের তথ্যে দেখা যায়, গত এক মাসেই চালের দর বেড়েছে ৫ দশমিক ৪১ শতাংশ, বোতলজাত সয়াবিন ১ দশমিক ৬২, মুগ ডাল ৩ ও ছোলা ২ শতাংশ দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১২৫ থেকে ১৩৫ টাকা কেজি দরে। এ সময়ে দাম বেড়েছে পাউডার মিল্ক, ডিম, শসাসহ অন্যান্য সবজির। শসার দাম এক মাসে প্রায় ১৫ শতাংশ বেড়ে ৭০ থেকে ৭৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে সাড়ে ৫ শতাংশ।

রাজধানীর আজিমপুর কাঁচাবাজারের চালের আড়তদার ইসমাইল হোসেন জানান, চালের বাজার কয়েক মাস ধরেই কিছুটা অস্থির। তিনি বলেন, গত এক সপ্তাহে পাইকারি পর্যায়ে বস্তাপ্রতি সব ধরনের চালের মূল্য প্রায় ১০০ টাকা বেড়েছে। এতে কেজিপ্রতি খুচরা বাজারে এক সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ২ থেকে ৩ টাকা। তিনি জানান, গত এক বছরের তুলনা করলে চালের দাম প্রায় ১৪ শতাংশ বেড়েছে। তবে টিসিবির দেওয়া তথ্যে দেখা গেছে, এক বছরের ব্যবধানে মোটা চালের দর বেড়েছে ১৩ দশমিক ৮৫ ভাগ এবং মাঝারি চালের দাম ১৩ দশমিক ৩৩ ভাগ।

বাজারে সবচেয়ে মূল্যবান পণ্য এখন আলু। গতকাল রাজধানীর পাইকারি হাট কারওয়ান বাজারে গিয়ে বিক্রেতাদের কাছ থেকে জানা গেছে, আলুর দাম পাইকারি মূল্যে ৫০ থেকে ৫২ টাকা। আর খুচরা বাজারে তা ৫৫ থেকে ৬৪ টাকা। তবে টিসিবির বৃহস্পতিবারের দেওয়া বাজারদর তথ্যে আলুর খুচরা মূল্য উল্লেখ করা হয়েছে ৫০ থেকে ৭৫ টাকা কেজি। বাজারে নতুন আলু এসেছে। তবে নতুন আর পুরোনো আলুর মূল্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। বাজারের পাইকারি বিক্রেতারা অভিযোগ করেছেন, কোল্ড স্টোরেজগুলো থেকে পর্যাপ্ত আলু দিচ্ছে না, ফলে এর প্রভাব পড়েছে দামে।

টিসিবির পণ্য বিক্রিতে বিশৃঙ্খলা : বাজার নিয়ন্ত্রণে টিসিবির পণ্য বিক্রিতেও চরম বিশৃঙ্খলার অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার বাইরের শহরগুলোয় ডিলারদের বিরুদ্ধে চাল, চিনি, ডাল বিক্রিতে অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলার অভিযোগ এখন নিয়মিত। অনুসন্ধানে জানা গেছে, টিসিবির ৮ হাজার ২৭৩ জন ডিলারের মধ্যে আট হাজারই আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী বা সমর্থক। যাদের বেশির ভাগই এখন পলাতক। এ অবস্থায় টিসিবির আঞ্চলিক কার্যালয়, আত্মীয়স্বজন ও স্থানীয় বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীদের সহায়তায় পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে।

সারা দেশে টিসিবির ১৪টি আঞ্চলিক কার্যালয় ৮ হাজার ২৭৩ জন ডিলার এবং এক কোটি ফ্যামিলি কার্ড তত্ত্বাবধান করছে। ঢাকা আঞ্চলিক কার্যালয়ের অধীনে মোট ডিলার সংখ্যা ১ হাজার ৭১৮ জন, একইভাবে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ে ২৮৭, খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ে ৫১৫, রাজশাহীতে ৩৮৩, রংপুর জোনে ৬৩১, বরিশাল আঞ্চলিক কার্যালয়ে ৫০০, দিনাজপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ে ২২৩, মৌলভীবাজার আঞ্চলিক কার্যালয়ে ৪২৭, ময়মনসিংহ আঞ্চলিক কার্যালয়ে ৮১৭, কুমিল্লা আঞ্চলিক কার্যালয়ে ৪৬৭, মাদারীপুর কার্যালয়ে ৪৬৭, ঝিনাইদহ আঞ্চলিক কার্যালয়ে ৪৬৩, বগুড়া আঞ্চলিক কার্যালয়ে ৭৭৯ এবং গাজীপুর ক্যাম্প অফিসে ৪৬১ জন ডিলার টিসিবি পণ্য সরবরাহ করে থাকেন।

শুল্কছাড়ের লাভ ব্যবসায়ীদের পকেটে : এদিকে বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার মধ্যেই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার চাল, চিনি, ডাল ও তেলে আমদানি শুল্ক কমিয়েছে। তবে শুল্কছাড়ের এই সুবিধা সাধারণ ক্রেতারা পাচ্ছেন না। এসব পণ্যের শুল্কছাড়ের পরও দাম কমছে না। চাল আমদানিতে শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ, রেগুলেটরি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ এবং ৫ শতাংশ আগাম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করেছে সরকার। ভোজ্য তেল আমদানিতে দুই দফায় শুল্ককর কমানো হয়েছে। প্রথম দফায় ১৭ অক্টোবর ও দ্বিতীয় দফায় ১৯ নভেম্বর শুল্ককর কমিয়ে তা নামানো হয়েছে শুধু ৫ শতাংশে। তাতে প্রতি কেজি অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলে শুল্ককর ১৭-১৮ টাকা থেকে কমে ৭ টাকায় নেমেছে। অর্থাৎ, প্রতি কেজি শুল্ককর কমেছে ১০-১১ টাকা। কিন্তু শুল্কছাড়ের পর তেলের দাম উল্টো লিটারপ্রতি ১০-১২ টাকা বেড়েছে। চিনি আমদানিতেও শুল্ককর কমিয়েছে সরকার। আগে প্রতি কেজি অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে ৩৮-৪০ টাকা শুল্ককর দিতে হতো। এখন দিতে হচ্ছে প্রতি কেজি ২৩ টাকা। অর্থাৎ, প্রতি কেজি শুল্ককর কমেছে প্রায় ১৫-১৭ টাকা।

শুল্ককর কমানোর পর গত মাসের ১৭ অক্টোবরের পর ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত চিনি আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৮১ হাজার টন। এর মধ্যে বাজারজাত হয়েছে ৫০ হাজার টন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, চিনি আমদানি পরিস্থিতি সন্তোষজনক। তবে বাজারের চিত্র উল্টো। পেঁয়াজ আমদানি বাড়াতে গত সেপ্টেম্বর ও নভেম্বরে দুই দফায় শুল্ককর কমায় সরকার। এতে গত এক মাসে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ৭৭ হাজার টনের কিছু বেশি। গত বছর একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৬১ হাজার টন।

বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে গত ৫ সেপ্টেম্বর আলু আমদানিতে শুল্ককর ছাড় দেয় সরকার। শুল্কছাড়ের পর আলু আমদানি হয়েছে ৪০ হাজার টন। তবে আমদানির পরও বাজারে বড় প্রভাব ফেলছে না। গত ১৭ অক্টোবর ডিম আমদানিতে শুল্ক ২৫ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। এরপর এখন পর্যন্ত ৫৫ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি পান ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানির অনুমতি দেওয়ার পরও আগের দামেই ডিম বিক্রি হচ্ছে।

আগামী মার্চে পবিত্র রমজান মাস শুরু হবে। তাই শুল্ককর কমানোর পাশাপাশি রোজার পণ্যের আমদানি বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংকও ঋণপত্রের শর্ত শিথিল করেছে। তবে এসবের কিছুই কাজে আসছে না।

আপনার সামাজিক মাধ্যমে খবরগুলো শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved © 2024
Developed BY www.budnews24.com