দেশে গত কয়েক দশক ধরে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের চর্চাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পঙ্গু করে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
তিনি এও অভিযোগ করেছেন যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কেবল দলীয়করণ নয়, বরং দুর্বৃত্তায়নও হয়েছে।
উপদেষ্টা বলেন, আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতাম তখন শিক্ষক নিয়োগে নিয়মনীতি মানা হতো। কিন্তু গত কয়েক দশকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রভাষক নিয়োগের প্রচণ্ড অনিয়ম শুরু হয়েছে। শুধু দলীয়করণ নয়, দুর্বৃত্তায়ন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে পঙ্গু করে দিয়েছে।
রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে রোববার প্রথম বাংলাদেশ উচ্চশিক্ষা সম্মেলন ২০২৪-এ প্রধান অতিথির বক্তব্য দিতে গিয়ে এসব কথা বলেন শিক্ষা উপদেষ্টা।
দৈনিক বণিক বার্তার আয়োজনে ‘উচ্চশিক্ষায় বৈশ্বিক মান: বাংলাদেশের করণীয়’ নিয়ে এ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়৷
এ সময় দেশের উচ্চশিক্ষায় বিদ্যমান কিছু সমস্যা তুলে ধরে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানের ভিন্নতা আছে। আমাদের উচ্চশিক্ষায় যে বড় সমস্যা আছে তা বোঝা যায় যখন উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে শিক্ষার্থীরা যাদের সামর্থ্য আছে তারা বিদেশে চলে যায়। দেশে উচ্চশিক্ষা শেষেও শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ কর্মহীন থেকে যায়। উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিংয়ে সমস্যা আছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চ শিক্ষার পরিবেশ নেই। এসবের কারণ সবার জানা, দলীয়করণ ও দুর্বৃত্তায়ন।
জুলাই-অগাস্টের অভ্যুত্থানের পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অভিভাবক শূন্য হয়ে পড়েছিল মন্তব্য করে তিনি বলেন, এ থেকে বোঝা যায় কিভাবে দলীয়করণ হয়েছে। এত অনিয়মের পরও পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বহু শিক্ষক আছেন যারা আন্তর্জাতিক মানের গবেষক।
শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতি, উচ্চ শিক্ষায় দলীয়করণ ও অপরাজনীতির উদাহরণ হলো শিক্ষাঙ্গনে মেধার অবমূল্যায়ন। জামাল নজরুল ইসলামের মত আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞানী যখন কেমব্রিজ ছেড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে সারাজীবন কাটিয়ে দিলেন, আমরা কী তাকে মূল্যায়ন করতে পেরেছি?
শিক্ষায় বাজেট বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই জানিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, হঠাৎ করে সেটি হবে না। কাদের দিয়ে শুরু করব? প্রাইমারি শিক্ষা? নাকি বেসরকারি খাতের এমপিওভুক্ত শিক্ষক যারা ১২ হাজার টাকা বেতন পেয়ে নিজ বাড়ি থেকে দূরে থাকেন? নাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান বাড়াবো?
অনুষ্ঠানে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সাম্প্রতিক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য নিয়োগ নিয়েও কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘অভ্যুত্থানের পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য পদায়ন শুরু হলেও অনেকে লেখালেখি করেছেন, বলা হয়েছে গতানুগতিক রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু যাদের উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাদের গবেষণার ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার সাইটেশন আছে।
একজন শিক্ষকের পাঁচ হাজারের বেশি সাইটেশন থাকলে তো তিনি অনেক বেশি গবেষণা করেন বলে বোঝা যায়। তাহলে তিনি রাজনীতি কখন করার সুযোগ পান?
সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষা এবং গবেষণা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন শিক্ষা উপদেষ্টা।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, পূর্ববর্তী সময়ে দেশের শিক্ষাঙ্গনে নানান সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এখানে রীতিমতো দুর্বৃত্তায়ন করা হয়েছে। আমরা সেগুলো বন্ধ করতে কাজ করছি, সেজন্য আমরা উপাচার্যসহ অন্যান্য নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্য ব্যক্তিদের আমরা নিয়ে আসছি। আমরা দেশের বাইরে থাকা ভালো শিক্ষক এবং গবেষকদের ফিরিয়ে আনতে কাজ করছি।
আমরা ব্রেইন ড্রেইন বা মেধা পাচারের কথা বলি। কিন্তু এ শিক্ষকদের ক্ষেত্রে দেখলাম এই প্রথম বিদেশ থেকে অনেকে ফিরে আসতে চাচ্ছে। যেটাকে আমরা বলি ব্রেইন সার্কুলেশন। নতুন ভিসিদের প্রোফাইল দেখে বিদেশে অবস্থানরত অনেকে বলছেন তাহলে দেশে ফিরে যাই না কেন?
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, কলেজগুলো গ্রামে ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনার্স-মাস্টার্স খুলে বসেছে কিন্তু শিক্ষক নাই। রাজনৈতিক বিবেচনায় জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়েছে। এটি কেন করা হয়েছে আমরা বুঝতে পারছি না। এর ফল কী হবে, তা নিয়েও ভাবতে হবে। এসব জায়গায় শিক্ষক নেই, শিক্ষার মান নেই। ফলে পড়াশোনার পর এসব শিক্ষার্থীদের কী হবে, সে চিন্তা করতে হবে।
উচ্চশিক্ষার মান বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে উন্নত করতে আন্তর্জাতিক মানের বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে কাজ করা যেতে পারে। সেজন্য এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা বাংলাদেশিদের নিয়ে আমরা শিক্ষার মান বাড়াতে কাজ করতে পারি, তাদের সুযোগ দিতে পারি। চীন এটি করছে। আমাদের এমন পরিবেশ এখনও হয়নি। সেজন্য আপাতত ভিজিটিং শিক্ষক হিসেবেও তাদের রাখা যেতে পারে।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) নাম পরিবর্তন করে বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন করে নতুন কিছু দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে বলে প্রস্তাব রেখেছেন উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, তারা একটি আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা নেটওয়ার্ক স্থাপন করতে পারে। যেন তারা উচ্চশিক্ষার মান এবং গবেষণা বৃদ্ধিতে কাজ করতে পারে।
ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচক হিসাবে বক্তব্য রাখেন বিশ্ববিদ্যালযয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল হান্নান চৌধুরী, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আবুল কাশেম মিয়া, আইইউবিএটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুর রব এবং ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম লুৎফর রহমান।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (অস্থায়ী) অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শাহিনুল আলমসহ আরো অনেকে।