রেল মন্ত্রণালয়ের নথিপত্রে আছে ৬৮৪০ একরের বেশি জমি অবৈধ দখলে আছে। রেলওয়ের ভূসম্পদ দপ্তরের মতে দখলকৃত জমির পরিমাণ ১০ থেকে ১২ হাজার একরের বেশি। রাজধানীতে প্রায় ৩০০ একর জমি বেদখলে আছে। কিন্তু রেল বলছে দখলদারদের কবলে আছে ১২০ দশমিক ৫০ একর জমি। রেল কর্তৃপক্ষ মাঝে মাঝেই জমি অবৈধ দখলমুক্ত করার ঘোষণা দিয়ে মাঠে নামে। কিন্তু তেমন সাফল্য আসে না। সংশ্লিষ্টদের মতে বেদখল জমির হিসাব না থাকলে উদ্ধার হবে কিভাবে। এছাড়া অবৈধ দখলদারদের বড় অংশই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। এরা গত রাজনৈতিক সরকারগুলোর সময় নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে এসব জমি দখলে রেখেছে।
রেলওয়ে অবকাঠামো দপ্তর সূত্রের খবর রেলপথমন্ত্রী বা সচিব বেদখল সম্পত্তির পরিমাণ জানতে চাইলে, এই বিভাগ থেকে নামমাত্র ছকে ইচ্ছেমতো জমির পরিমাণ বসিয়ে দেওয়া হতো। প্রকৃত হিসাব রাখার মতো জনবল সংশ্লিষ্ট বিভাগে নেই। কাজেই কাগজে-কলমে দখল বা বেদখলের যে হিসাব আছে তার সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
বর্তমান সরকার জমি উদ্ধারে কঠোর নির্দেশ দিয়েছে। এতে ব্যতিক্রম কিছু ঘটতে পারে বলে আশা করছেন রেল কর্তৃপক্ষ। রেলের জমি বেহাত হয়ে যাওয়া নিয়ে ক্ষুব্ধ রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা। তিনি সচিবকে নিয়ে বৈঠক করে জমি উদ্ধারে কঠোর পদক্ষেপের নির্দেশ দিয়েছেন। যে কোনো মূল্যে বেদখলকৃত জমি উদ্ধার করতে হবে। এরপর থেকে রেল প্রশাসনের অভ্যন্তরে নড়াচড়া শুরু হয়েছে। ৫ ডিসেম্বর রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এতে ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে অবৈধ দখলদারদের রেলের জায়গা ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এমন বিজ্ঞপ্তিতে গা ঢাকা দিতে শুরু করেছে অবৈধ দখলদাররা। যা এর আগে দেখা যায়নি। এর আগে যখনই জমি উদ্ধারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে তখন-দখলদাররা রাজনৈতিক পরিচয়ে রেলপথ ভবনসহ বিভিন্ন পর্যায়ে ম্যানেজ করে নিয়েছে। কিন্তু এবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হুঁশিয়ারির পর ‘ম্যানেজ’ পার্টির আনাগোনা চোখে পড়ছে না-বলছিলেন সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দখলকৃত জমি উদ্ধারে কঠোর অবস্থানে আছি। দখল নিয়ে অনেক হয়েছে-আর নয়। যাত্রী পরিবহণে রেলে আয় বাড়ানোর চেয়ে মালবাহী এবং জমি ব্যবহার করে আয় দ্বিগুণ করার উদ্দেশ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে। দখলের সঙ্গে রেলের কারও সম্পৃক্ততা থাকলে-চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জমি উদ্ধারের পাশাপাশি দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো রাজনৈতিক কিংবা প্রভাবশালীর আনাগোনা-তদবির, বাধা, যুক্তিতর্ক কোনো কিছুই আমলে নেওয়া হবে না। আমরা সিলেটে প্রায় ৪০০ একর জমি ইতোমধ্যে দখলমুক্ত করেছি। চলছে অভিযান, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। অবৈধ কোনো স্থাপনাই রাখা হবে না।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের নথিপত্রের সূত্রে জানা যায়, রেলে মোট জমির পরিমাণ ৬১ হাজার ৮২০ দশমিক ৯৭ একর। এর মধ্যে পশ্চিমাঞ্চল রেলের ৩৭ হাজার ৪১৯.৩৫ একর এবং পূর্বাঞ্চল রেলে ২৪ হাজার ৪০১. ৬২ একর জমি আছে। মোট জমির ৫১ শতাংশ ব্যবহৃত হয় রেলের নিজ কাজে। ইজারা দেওয়া হয়েছে ১৪ হাজার ৪৭৩ একর জমি। বাকিগুলো কি অবস্থায় আছে তার প্রকৃত তথ্যের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। রেলের জায়গা দখল করে কোথাও হয়েছে বহুতল। কোথাও সারি সারি দোকান, বাড়ি, বাজার, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ গ্যারেজ-গুদাম। রেলে হাজার হাজার একর জমি দখলের ছবি স্পষ্ট। অতীতের সরকারগুলোর সময় জমি উদ্ধার অভিযান পরিচালনায় যোগফল এসেছে শূন্য। খোদ রেলওয়ে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় হাজার হাজার একর জমি বেদখল হয়েছে। উচ্ছেদ অভিযান ছিল নিতান্তই ‘ভাঁওতাবাজি’। অধিকাংশ অভিযান পরিচালিত হয়েছে দখলকৃত জমিটির হাত বদলের জন্য। দীর্ঘ সময়ে জমি দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া, গ্রেফতার কিংবা শাস্তি নিশ্চিত করার তথ্য-উপাত্ত একেবারেই শূন্য। পুরো দখল বাণিজ্যই ছিল রাজনৈতিক। এমন কোনো রেলওয়ে স্টেশন নেই-যেখানের জমি অবৈধ দখলদারদের কব্জায় নেই। এমন কি স্টেশনের ভেতরও শত শত দোকান অবৈধ ভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। খোদ রাজধানীর বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনের ভেতর অর্ধেক দোকানই অবৈধ। তাছাড়া এ স্টেশনের প্রায় ৯০ শতাংশ দোকান রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নেওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় রেলের জমি হরিলুটের চেষ্টা চলছে। সম্প্রতি ওই এলাকায় রেলের একটি জলাশয় নানা নামে দখলের পাঁয়তারা চলছে।
রাজধানীর আনন্দবাজার অর্থাৎ পুরাতন ফুলবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন ঘিরে প্রায় ৪ একর জমি বেদখলে রয়েছে যুগের পর যুগ ধরে। রেলের জমিতে বিশাল বহুতল মার্কেটসহ অন্তত ৫ শতাধিক ছোট-বড় স্থাপনা রয়েছে। ফুলবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনের কোনো অস্তিত্বই দেখা যায়নি। এটি দিন দিন আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনেতিক দলের ছত্রছায়ায় দখলে নেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের রেলপথমন্ত্রীরা (৫ জন মন্ত্রী) বেশ কয়েকবার লোক দেখানো উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করেন। কিন্তু, একটি দোকানও উচ্ছেদ করতে পারেননি।
অভিযোগ রয়েছে, উচ্ছেদের ‘নির্দেশ’ই ছিল ঘুস বাণিজ্যের। একেকটি নির্দেশনায় কোটি কোটি টাকা লুটে নিতেন সংশ্লিষ্টরা। রাজধানীতে রেলের ১২টি মার্কেটও এখন প্রায় বেদখলে। একেকটি মার্কেটের দোকান ইচ্ছেমতো ১০ থেকে ১৫ হাতে বিক্রি করা হয়েছে। রাজধানী কিংবা বড় শহরগুলোতে রেলের জমিতে অবৈধভাবে নির্মিত বহুতল ভবন, মার্কেটসহ স্থাপনাগুলো দ্রুত উচ্ছেদের পর রেলের দখলে নেওয়া হবে-এমন দাবি জানিয়েছেন রেলের মাঠপর্যায়ে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
রেলের এক ভূ-সম্পদ কর্মকর্তা বলেন, তারা রেলের বাইরে থেকে এসে দায়িত্ব পালন করেন। রেলওয়ে পুলিশ, নিরাপত্তা বাহিনীর সহযোগিতা খুব একটা পাওয়া যায় না। তাছাড়া উদ্ধার কিংবা উচ্ছেদ কার্যক্রম চালাতে গিয়ে তাদের সদস্যরা ( ভূ-সম্পদ কর্মকর্তা) বহুবার মারধরের শিকার হয়েছেন। রাজধানীর শাহজাহানপুর এলাকায় এক কর্মকর্তা দখলদারের গুলি পর্যন্ত খেয়েছেন। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় দখলে থাকা জমি নামে মাত্র উদ্ধার করা হলেও ফের দখলে চলে যায়। রেলে এমন নজির নেই-জমি দখল হচ্ছে কিংবা দখলকৃত জমি পুনরায় দখলে নেওয়া হচ্ছে, সেখানে রেল পুলিশ কিংবা নিরাপত্তা বাহিনী বাধা কিংবা প্রতিরোধ সৃষ্টি করেছে। তিনি অভিযোগ করেন, রেলওয়ের অনেকেই দখলদারদের হয়ে সংঘর্ষে পর্যন্ত লিপ্ত হয়। তারা বিভিন্ন দলের নেতাকর্মী। রেলে নামে মাত্র দুই অঞ্চলে দুজন আইনজীবী আছেন। দখলদাররা হাজার হাজার মামলা করে রেখেছে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। এ ক্ষেত্রে আইনি সহায়তা নেই বললেই চলে। দখলবাজরা একটি স্টে-অর্ডার এনে বছরের পর বছর দখলে রাখছে রেলের জমি।
রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, রেলের বিপুল পরিমাণ জমি অব্যবহৃত এবং অবৈধ দখলে রয়েছে। বিভিন্ন সময় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হলেও তেমনটা কার্যকর হয়নি। এ খাতে লোকবলের অভাব। তাছাড়া উদ্ধারকৃত জমি দ্রুত কাজেও লাগানো যাচ্ছে না। ফলে দখলদারদের কব্জায়ই থেকে যাচ্ছে অনেক জায়গা। এবার কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। সেই নির্দেশনা আমরা সর্বোচ্চ কার্যকর করব। রাজনৈতিক প্রভাব না থাকলে জমি দখলমুক্ত করা সম্ভব হবে।
রেলওয়ে মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আমরা রেলের জমি পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যবহার করে আয় বাড়াতে চাই। রেলের জমি উদ্ধারের কোনো বিকল্প নেই। আমরা এখন মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা পাচ্ছি, এতে মাঠপর্যায়ে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও সাহস পাচ্ছেন। সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, উদ্ধারকৃত জায়গা খালি না রেখে পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যবহার করা হবে। এতে রেলের আয়ও বাড়বে। শুধু যাত্রী পরিবহণে আয় বাড়ানো সম্ভব নয়। রেলের অব্যবহৃত ও উদ্ধারকৃত জমি হবে আয়ের আরেকটি বড় উৎস।