বাংলাদেশে সরকারের মেয়াদ কমিয়ে চার বছর করার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের মন্তব্যের পর এটি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর, যা পরিবর্তন করতে হলে সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন। তবে এটি করতে জাতীয় সংসদকে সংশোধনী প্রস্তাবনা গ্রহণ করতে হবে। বিএনপি ও জামায়াতের মতো প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য না করলেও, তাদের শীর্ষ নেতারা সরকারের মেয়াদ কমিয়ে চার বছর করার বিরোধিতা করেছেন।
বাংলাদেশে দীর্ঘকাল ধরে রাজনৈতিক, নির্বাচনি ও রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়ে কাজ করে আসা বেসরকারি সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার জানান, সংসদ বা সরকারের মেয়াদ নিয়ে কখনো তেমন কোনো আলোচনার উদাহরণ আগে শোনা যায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, ‘সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ কিংবা রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়ে থাকে, তবে সরকারের বা সংসদের মেয়াদ কমানোর আলোচনা আগে শোনা যায়নি।’
এদিকে, সংসদ ও সরকারের মেয়াদ নিয়ে এই নতুন আলোচনার মধ্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একটি আলোচনা সভায় সরকারের কর্মকাণ্ডের ফোকাস এক জায়গায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ফোকাসটা হচ্ছে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থাকে ঠিক করা, এবং তারপর নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। বাকিগুলো নির্বাচিত সরকার করবে।’ অর্থাৎ, বিএনপি চায়, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধানসহ অন্যান্য সংস্কারের উদ্যোগ নির্বাচনের পর ক্ষমতায় আসা সরকার করবে।
প্রধান উপদেষ্টার মন্তব্য ও নানা প্রতিক্রিয়া
বিদেশি একটি সংবাদ মাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তার অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, “আমরা স্থায়ী সরকার নই। উদাহরণ হিসেবে মনে করুন, আমাদের এখানে নিয়মিত সরকারের মেয়াদ হয় ৫ বছর। এটাই বিষয়। কিন্তু নতুন সংবিধানে হয়তো এর মেয়াদ করা হচ্ছে ৪ বছর। কারণ, জনগণ দ্রুততার সঙ্গে অগ্রসর হতে চায়। এ জন্য এর (অন্তর্বর্তী সরকারের) মেয়াদ ৪ বছরের নিচে থাকা উচিত। এটা নিশ্চিত। এর চেয়ে কমও হতে পারে। তবে বিষয়টি হলো জনগণের, তারা কি চায়। রাজনৈতিক দলগুলো কি চায়”।
এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ চার বছর হতে পারে, প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্ধৃত করে এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে তার প্রেস উইং থেকে এর এক ব্যাখ্যা দেয়া হয়।
এক সংবাদ সম্মেলনে তার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ চার বছরই হবে এমন কথা বলেননি।
তিনি বলেন, “পুরো বিষয়টা ক্লিয়ার করতে হবে। পুরো ইন্টারভিউটা আপনারা (গণমাধ্যম কর্মী) ভালোভাবে শুনেন। ইন্টারভিউতে তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) কি বলেছেন? সংবিধান নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে পার্লামেন্টের ডিউরেশন চার বছরে আনা হোক। এই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি কথাটা বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ প্রসঙ্গে তিনি এটা বলেননি”।
সরকারের চার বছরের মেয়াদের কথা আগে এসেছে?
কয়েক দশক ধরে নির্বাচনি ও রাজনৈতিক সংস্কার নিয়ে সোচ্চার থাকা বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, সরকার বা সংসদের মেয়াদের বিষয়টি কখনো গুরুত্ব পেতে তিনি দেখেননি।
“এটি (সরকার বা সংসদের মেয়াদ ৪ বছর করা) সেভাবে আলোচনায় এসেছে বলে মনে পড়ে না। এটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু সরকার গণতান্ত্রিক হলে বা রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি থাকলে মেয়াদ কোন বিষয় নয়। শাসক ভালো না হলে যে কোন মেয়াদই খারাপ,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
বাংলাদেশের সরকার ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় যে ঐক্যমত্য হয়েছিলো ১৯৯০ সালে জেনারেল এরশাদের পতনের পর, তার লিখিত রূপ ছিলো- তিন জোটের রূপরেখা। সেই রূপরেখাতেও সরকার বা সংসদের মেয়াদ কমানো বা বাড়ানো নিয়ে কোন মন্তব্য ছিলো না।
এরপর বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে রাজনৈতিক সংকটের জের ধরে ২০০৪ সালে প্রথম আলো, ডেইলি স্টার ও চ্যানেল আইয়ের যৌথ উদ্যোগে সংস্কারের যে প্রস্তাব রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত ছিলো, সেখানেও সরকার বা সংসদের বিষয়টি ছিলো না বলে জানিয়েছেন মি. মজুমদার।
এরপর গত দেড় দশকে নির্বাচন নিয়ে চরম বিতর্ক ও অচলাবস্থার প্রেক্ষাপটে সুজনসহ বিভিন্ন সংগঠন যেসব সংস্কার প্রস্তাব এনেছে তাতেও সরকারের মেয়াদ কমানো বা বাড়ানোর বিষয়ে কোন প্রস্তাবনা শোনা যায়নি।
এমনকি ২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার আগে আওয়ামী লীগ যে ‘দিন বদলের সনদ’ দিয়েছিলো সেখানেও এমন কিছু ছিলো না।
আবার ২০১৭ সালে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ‘ভিশন-২০৩০’ এবং ২০২২ সালের ডিসেম্বরে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলের ‘রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের’ রূপরেখা ঘোষণা করেছেন। সর্বশেষ গত বছর জুলাই দলটি যে ৩১ দফা ঘোষণা করেছে, এর কোনটিতেই সরকার বা সংসদের মেয়াদ বিষয়ে কোন কিছু বলা হয়নি।
তবে জানা গেছে, সংবিধান বিষয়ে সরকারের যে কমিশন কাজ করছে, তাদের সাথে আলোচনা কালে কেউ কেউ সরকার বা সংসদের মেয়াদ চার বছর করার প্রস্তাব দিয়েছেন।
যদিও শেষ পর্যন্ত কমিশনের সুপারিশে এটি উঠে আসে কি না সেদিকেই এখন অনেকের দৃষ্টি থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে।
অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন অবশ্য বলছেন, সংসদ বা সরকারের মেয়াদ আলোচনায় টেনে আনাটাই অপ্রয়োজনীয় বিষয়।
‘আর এগুলো দরকার হলেও সেটি করার এখতিয়ার শুধুমাত্র নির্বাচিত সংসদের,’ তিনি বলেন।
চার বছর মেয়াদ কোথায় আছে?
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের মেয়াদ চার বছর হওয়ায় সেখানকার সরকারকে চার বছর মেয়াদী বলে বলা হয় এবং এটিই চার বছর মেয়াদী সরকারের সবচেয়ে শক্তিশালী উদাহরণ।
জার্মানি, সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক বা সুইজারল্যান্ডসহ ইউরোপের অনেক দেশের প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ চার বছর হয়ে থাকে।
আগে কানাডায় পার্লামেন্টের মেয়াদ পাঁচ বছর থাকলেও ২০০৭ সালে সেটি কমিয়ে চার বছর করা হয়েছে। অন্যদিকে অতীতে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের মেয়াদ সাত বছর হলেও ২০০২ সালে কমিয়ে পাঁচ বছর করা হয়।
তবে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোসহ বিশ্বজুড়ে অনেক দেশে সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর।
এর বাইরে বাংলাদেশ যে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট মিনিস্টার সিস্টেম অনুসরণ করে বলে দাবি করা হয়, সেই যুক্তরাজ্যেও সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছরই।
এ অবস্থায় বাংলাদেশের সংবিধানে নিয়মিত সরকারের মেয়াদ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার মন্তব্য নিতান্তই ব্যক্তিগত অভিমত নাকি অন্তর্বর্তী সরকারেরই দৃষ্টিভঙ্গি সেটি এখনো পরিষ্কার নয়।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল মঙ্গলবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘চার বছরের বিষয়টা সম্পূর্ণ ‘আউট অফ কনটেক্সট’, এ ধরনের কিছু বলাই হয়নি।’