জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বহুল আলোচিত-সমালোচিত ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) কারিগরি স্বত্ব এখনো বুঝে পায়নি নির্বাচন কমিশন (ইসি)। চলতি বছরের ৩০ জুন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। ইভিএম সংগ্রহ চুক্তিতেও অস্পষ্টতা রয়েছে। এসব কারণে দেড় লাখ ইভিএম, এসব মেশিনের কারিগরি ডকুমেন্টস এবং প্রকল্পের আওতায় কেনা মালামাল বুঝে পেতে জটিলতার মধ্যে পড়েছে কমিশন সচিবালয়।
ইভিএম’র সফটওয়্যারের আনএনক্রিপটেড সোর্সকোড ও আর্কিটেকচার, ডাটাবেজ আর্কিটেকচার, ডকুমেন্টেশনসহ কারিগরি সবকিছুই বুঝিয়ে দিতে সম্প্রতি প্রকল্প ও সরবরাহকারী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সম্প্রতি নির্দেশনা দিয়েছে ইসি। পাশাপাশি ওইসব মালামাল বুঝে নেওয়ার জন্য ব্যয় না বাড়িয়ে শুধু মেয়াদ বাড়াতে পরিকল্পনা কমিশনকে অনুরোধ জানিয়ে আসছে ইসি। অবশ্য প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, দেড় লাখ ইভিএম যেখানে যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থায় বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছেন। তবে কারিগরি স্বত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন সচিব শফিউল আজিম যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পের আওতায় কেনা দেড় লাখ ইভিএম, ইভিএমে ব্যবহার করা টেকনোলজি, গাড়িসহ অন্যান্য সবকিছুই নির্বাচন কমিশনের। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়বে বাড়বে এমন আশায় এসব কিছুই বুঝে নেওয়া হয়নি। এখন আমরা এসব জিনিস বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, সমস্যা হচ্ছে টেকনোলজি ট্রান্সফার নিয়ে। ওই প্রযুক্তির সঙ্গে ইসির জনবল যুক্ত ছিল না। আমাদের দক্ষ জনবল নেই। আমাদের জনবলকে প্রশিক্ষণ দিতে যারা ইভিএম তৈরি করেছে তাদের দরকার হবে। এসব বিষয় সমাধানে আলোচনা চলছে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৮ সালে তিন হাজার ৮২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘নির্বাচন ব্যবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তি প্রয়োগের লক্ষ্যে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার’ শীর্ষক প্রকল্প অনুমোদন করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। ২০২৩ সালের জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা এক বছর বাড়ানো হয়। বিএনপিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের বিরোধিতার মধ্যেই ওই প্রকল্পের আওতায় সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে (ডিপিএম) দেড় লাখ ইভিএম কেনা হয়। ওই নির্বাচনে মাত্র ছয়টি আসনে এ মেশিনে ভোটগ্রহণ হয়। পরে এক হাজারের বেশি বিভিন্ন ধরনের নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়। নির্বাচন কমিশন ও প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের দাবি, ইভিএমে কারচুপি হয়েছে এমন অনেক অভিযোগ আছে কিন্তু তা কেউ প্রমাণ করতে পারেনি। ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ইভিএমের কারিগরি স্বত্ব বুঝে নেওয়া এবং এ মেশিন দিয়ে নির্বাচনে পরিচালনা করতে পারবেন-নির্বাচন কমিশনের এমন পর্যাপ্ত দক্ষ কর্মকর্তা তৈরি হয়নি। প্রকল্পে ইসির যেসব কর্মকর্তা যুক্ত ছিলেন তারাও এদিকে মনোযোগ দেননি। সম্প্রতি ইভিএম কাস্টমাইজ করার জন্য নির্বাচন কমিশনের ৪০ জন কর্মকর্তাকে প্রকল্প থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ওই প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর ইভিএমে নির্বাচন না হওয়ায় তারা কতটা পারদর্শী হয়েছেন তা পরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি। তারা আরও জানান, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সহযোগিতা না করলে এসব ইভিএম আর কোনো নির্বাচনে ব্যবহার করা সম্ভব হবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় কেনা দেড় লাখ ইভিএমের মধ্যে মাঠ পর্যায়ে ৬২ হাজার ৬৪৭টি, বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিতে (বিএমটিএফ) ৮৬ হাজার ৫৭৮টি ও নির্বাচন ভবনে কাস্টমাইজেশন সেন্টারে ৬১৮টি রাখা হয়েছে। আর আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়েছে ১৫৭টি। যদিও ইসির আঞ্চলিক কর্মকর্তাদের প্রতিবেদনে মাঠ পর্যায়ে ৬১ হাজার ২২০টি ইভিএম রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই হিসাবে এক হাজার ৪২৭টি ইভিএমের খোঁজ নেই।
আরও জানা গেছে, ইভিএম’র কারিগরি স্বত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার বিষয়ে সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে জোরালো আলোচনা হয়। ওই বৈঠকে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিএমটিএফ ও প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, ইভিএম’র আপডেট সফটওয়্যার ইসিকে দেওয়া হয়নি। ওই সফটওয়্যার সোর্সকোডসহ ইসিকে বুঝিয়ে দিতে হবে। ইভিএমে ইন্সটল করা সফটওয়্যার কখনোই হস্তান্তর করা হয়নি। সফটওয়্যারগুলো যাতে নতুন কোনো ডিভাইসে ইন্সটল করা যায়-সেই সক্ষমতা ইসির প্রতিনিধিদের বুঝিয়ে দিতে হবে, যাতে তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। বৈঠকে ইভিএম ইন্সটল থাকা সফটওয়্যার, কাস্টমাইজেশন সফটওয়্যার এবং এসডি কার্ড, অডিট কার্ড এবং পোলিং কার্ড প্রক্রিয়াকরণ ও মুদ্রণের জন্য সফটওয়্যারের সোর্সকোড বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে অনুরোধ জানানো হয়। একই সঙ্গে এসব সফটওয়্যার বুঝে নেওয়ার জন্য ইসির কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। এ বিষয়ে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা বৈঠকে বলেন, সোর্সকোডের বিষয়ে কারিগরি দল ও নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এক্ষেত্রে চুক্তি এবং সোর্সকোড সংরক্ষণের ইসির কর্মকর্তাদের দক্ষতা নিয়েও আলোচনা হয়।
ওই বৈঠকে বিএমটিএফ’র কর্মকর্তারা ইভিএম ও প্রকল্পের মালামাল সংরক্ষণের জন্য ইসি ভাড়া পরিশোধ করছে না বলে অভিযোগ করেন। তারা ইসিকে বলেন, ইভিএম যেখানে যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থায় হিসাব মিলিয়ে দেওয়া হবে। হার্ডওয়্যার হস্তান্তরের প্রক্রিয়া আলোচনা করে নির্ধারণ করা হবে। এসডি কার্ড, অডিট কার্ড এবং পোলিং কার্ড প্রক্রিয়াকরণ ও মুদ্রণের বিষয়টি আলোচনা করে সমাধান করা হবে বলে আশ্বস্ত করেন।
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, সরবরাহের পরপরই ইসির কমিটির দেড় লাখ ইভিএম রিসিভ করেছেন। প্রকল্পের শেষ পর্যায়ে এসে এখন ইসির মাঠ কার্যালয়, নির্বাচন ভবনে থাকা কাস্টমাইজেশন সেন্টার ও বিএমটিএফে থাকা ইভিএম এবং র্যাক ইসিকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, গত মার্চ-এপ্রিলে মাত্র ৪৫ হাজার ইভিএম সচল থাকার কথা প্রকল্প থেকে জানানো হয়। এখন কতগুলো ইভিএম সচল, কতগুলো পুরোপুরি অচল এবং কতগুলো মেরামতযোগ্য তার তালিকা চাওয়া হয়েছে। এজন্য একটি সফটওয়্যারও তৈরি করা হয়েছে। তবে সেখানে সব ইভিএম’র বর্তমান অবস্থার তথ্য নেই। তারা বলেন, প্রকল্পে ইভিএম সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বিপাকে আছে ইসি সচিবালয়। ইসির সর্বশেষ সমন্বয় সভায় ইসি সচিব শফিউল আজিম ১০ আঞ্চলিক কর্মকর্তাকে ওয়্যারহাউজের জন্য জমি খোঁজার পরামর্শ দেন। সেখানে ইভিএম ছাড়াও নির্বাচনি সামগ্রী মজুত করা হবে বলে ওই বৈঠকে জানানো হয়।